হিন্দু শাস্ত্র - হিন্দু পেইজ

হিন্দু পেইজ

সনাতনী সংবাদ বিশ্বময়

Breaking

Thursday, February 20, 2020

হিন্দু শাস্ত্র

আমরা যদি বিশ্বের অন্যান্য প্রধান ধর্মগুলির দিকে তাকাই, তাহলে দেখব প্রতিটি ধর্মই কোনো না কোনো একক ধর্মপ্রচারকের দ্বারা প্রবর্তিত। গৌতম বুদ্ধ বৌদ্ধধর্ম প্রবর্তন করেছিলেন ; যিশু খ্রিস্ট খ্রিস্টধর্ম এবং হজরত মহম্মদ ইসলাম ধর্ম প্রবর্তন করেন। কিন্তু আমাদের হিন্দুধর্ম কোনো এক জন মাত্র ব্যক্তির দ্বারা প্রবর্তিত হয়নি। এটি আমাদের ধর্মের একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য। কোনো এক জন মানুষের জীবনকথা হিন্দুধর্মের ভিত্তি নয়। তাহলে আমাদের হিন্দুধর্মের ভিত্তিটি কী ; এর প্রামাণিকতাই বা কোথায়? হিন্দুধর্মের ভিত্তি হল সেই পরম সত্য ; যাঁকে ঈশ্বর নামে সকল ধর্মে পূজা করা হয়। ব্রহ্মজ্ঞ ঋষিদের ঈশ্বরদর্শনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাই হিন্দুধর্মের প্রামাণিকতা। আমরা সাধারণ মানুষেরা ঈশ্বর সম্পর্কে যা অনুভব করি, তা অসম্পূর্ণ। একমাত্র মহান ঋষিদের কাছেই ঈশ্বরের মহান সত্যটি প্রকাশিত হয়। প্রাচীন কালের ঋষিগণ তাঁদের এই ঈশ্বরানুভূতির কথা ধরে রেখেছিলেন ‘শ্রুতি’ নামে এক শ্রেণির শাস্ত্রে।



বৈদিক সাহিত্য

বেদ

শ্রুতি কী? ‘শ্রুতি’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ হল ‘যা শোনা হয়েছে’। সুপ্রাচীন কালের বৈদিক ঋষিরা কঠোর তপস্যা করে নিজেদের শুদ্ধ করেন। তখন তাঁরা তাঁদের হৃদয়ে স্বয়ং ঈশ্বরের বাণী শুনতে পান। ঈশ্বরের মুখ থেকে শোনা এই সত্যগুলি তাঁরা যে পবিত্র গ্রন্থরাজিতে ধরে রাখেন, তারই নাম হল ‘শ্রুতি’। শ্রুতি মানুষের লেখা বই নয় ; তাই শ্রুতিকে বলা হয় ‘অপৌরুষেয়’। শ্রুতিকেই আমরা সাধারণত চিনি ‘বেদ’ নামে। ‘বেদ’ শব্দের অর্থ ‘জ্ঞান’। এই প্রসঙ্গে স্বামী নির্মলানন্দ লিখেছেন, “হিন্দুদের কয়েকখানি বিশেষ ধর্মগ্রন্থকে কেন বেদ বলে তাহার একটি কারণ আছে। সংস্কৃতে ‘বিদ্‌’ ধাতুর অর্থ ‘জানা’। এই ধাতু হইতে নিষ্পন্ন বলিয়া ‘বেদ’ শব্দের মূল অর্থ ‘জ্ঞান’। বেদ বলিতে বিশেষতঃ ঈশ্বর, জীব ও জগৎ সম্বন্ধে পারমার্থিক জ্ঞানই বুঝায়। সৃষ্টিও যেমন অনাদি ও অনন্ত, ঈশ্বর সম্বন্ধে জ্ঞানও তেমনই অনাদি অনন্ত। ঈশ্বর সম্বন্ধে এই শাশ্বত ও অফুরন্ত জ্ঞানরাশিই বেদ শব্দের মুখ্য অর্থ। এই অপরিসীম জ্ঞানরাশির কিছু অংশের সন্ধান হিন্দু তত্ত্বদ্রষ্টাগণ পাইয়াছিলেন। তাহাই লিপিবদ্ধ হইয়া বেদ নামে প্রচলিত হইয়াছে।” বেদের আরও দুটি নাম হল ‘আগম’ ও ‘নিগম’। ‘আগম’ শব্দের অর্থ ‘যা ঐতিহ্য রূপে আমাদের কাছে এসেছে’ এবং ‘নিগম’ শব্দের অর্থ হল ‘যা জীবনের মূল সমস্যাগুলির স্পষ্ট ও নিশ্চিত সমাধান নির্দেশ করে’। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ‘আগম’ ও ‘নিগম’ তন্ত্রশাস্ত্রের দুটি বিভাগেরও নাম ; সেগুলি সম্পর্কে পরে যথাস্থানে আলোচনা করা হবে।

বেদ চারটি। যথা–(১) ঋগ্বেদ, (২) সামবেদ, (৩) যজুর্বেদ ও (৪) অথর্ববেদ। এগুলির মধ্যে ঋগ্বেদ সবচেয়ে পুরনো ও সবচেয়ে বড়ো। ঋগ্বেদ প্রধানত ‘ঋক’ বা প্রার্থনা মন্ত্রের সংকলন। হিন্দুধর্মের বিখ্যাত গায়ত্রী মন্ত্র ঋগ্বেদ-এরই অংশ। সামবেদ-এ ঋগ্বেদ-এর বাছাই করা কয়েকটি সূক্তে সুরারোপ করে কয়েকটি যজ্ঞের বিশেষ বিশেষ পর্যায়ে সেগুলি গান করার নির্দেশ দেওয়া আছে। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের আদি উৎস হল এই সামবেদ। যজুর্বেদ-এ রয়েছে মূলত যাগযজ্ঞের নিয়মকানুন। অথর্ববেদ অপেক্ষাকৃত পরবর্তীকালের রচনা। এই বেদে রয়েছে নীতিতত্ত্ব ও আয়ুর্বেদ ইত্যাদি কয়েকটি বিজ্ঞানের বর্ণনা।

এই চারটি বেদের প্রতিটি আবার চারটি করে অংশে বিভক্ত। এগুলি হল–(১) সংহিতা বা মন্ত্রভাগ, (২) ব্রাহ্মণ, (৩) আরণ্যক ও (৪) উপনিষদ্‌। ‘সংহিতা’ অংশে লিপিবদ্ধ হয়েছে ইন্দ্র, অগ্নি, বরুণ, বিষ্ণু, রুদ্র প্রমুখ বৈদিক দেবতার বিভিন্ন মন্ত্র ও স্তবস্তুতি। ‘ব্রাহ্মণ’ অংশে রয়েছে মন্ত্রের ব্যাখ্যা ও যাগযজ্ঞের নিয়মকানুন। কোন যজ্ঞে কোন মন্ত্র উচ্চারণ করা দরকার, তা জানা যায় ব্রাহ্মণ অংশ থেকে। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভাল যে, ব্রাহ্মণ জাতির সঙ্গে এই গ্রন্থের কোনো সম্পর্ক নেই। ‘আরণ্যক’ অংশে রয়েছে বনবাসী তপস্বীদের যজ্ঞভিত্তিক বিভিন্ন ধ্যানের বর্ণনা। ‘উপনিষদ্‌’ অংশটিতে পরম সত্যের এক মরমিয়া ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। পরম সত্যকে উপলব্ধি করার শ্রেষ্ঠ পন্থাটিও উপনিষদ্‌ই আমাদের শিক্ষা দেয়। স্বামী হর্ষানন্দের ভাষায়, “উপনিষদ্‌গুলি হলো দার্শনিক নিবন্ধ। এদের উপজীব্য ‘বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অন্তরালবর্তী সত্যবস্তু’, ‘মানুষের প্রকৃত স্বরূপ’, ‘জীবনের উদ্দেশ্য ও সেই উদ্দেশ্যসাধনের উপায়’ প্রভৃতি বিষয়।”

বেদই আমাদের সর্বোচ্চ ঈশ্বরের কাছে পৌঁছনোর পথ বলে দেয়। বেদই আমাদের পরম সত্য সম্পর্কে জানান দেয়। সত্য চিরন্তন। আর বেদ এই সত্যকে প্রকাশ করে বলে বেদও চিরন্তন। তাই বেদই হিন্দুধর্মের সর্বোচ্চ ও সর্বপ্রধান প্রামাণ্য ধর্মগ্রন্থ।

প্রস্থানত্রয়

চলে আসি ‘প্রস্থানত্রয়’-এর কথায়। উপনিষদ্‌, গীতা ও ব্রহ্মসূত্র–এই তিন ধর্মগ্রন্থকে একসঙ্গে বলা হয় ‘প্রস্থানত্রয়’। হিন্দু সমাজে এই তিনটি বইয়ের প্রভাব অসীম। হিন্দুদের প্রধান সম্প্রদায়গুলি প্রস্থানত্রয়কে ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে। সম্প্রদায়ের প্রবর্তকেরা এগুলির ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়ে অদ্বৈত, দ্বৈত, বিশিষ্টাদ্বৈত ইত্যাদি মতবাদ প্রচার করেছেন।

উপনিষদ্‌

কেউ কেউ প্রশ্ন করবেন, বেদের প্রতিটি অংশ ও প্রতিটি শব্দই কী গুরুত্বপূর্ণ? এর উত্তরে বলতে হয়, বেদ একটা বিরাট গাছের মতো। এই গাছের শিকড় ও কাণ্ড হল মন্ত্র ও যাগযজ্ঞ। আর ফল হল উপনিষদ্‌। তবে একথা মানতেই হবে যে, উপনিষদ্‌ই বেদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

‘উপনিষদ্‌’ বলতে বোঝায় যেই গুহ্য ও পবিত্র জ্ঞান যা অজ্ঞানকে দূর করে আমার পরম সত্য বা ব্রহ্ম সম্পর্কে অবহিত করায় এবং সেই ব্রহ্মজ্ঞানের মাধ্যমে আমাদের জাগতিক বন্ধনগুলিকে আলগা করে দেয়। উপনিষদ্‌ হল বেদের শেষ ভাগ ; তাই এর অপর নাম ‘বেদান্ত’। অন্য মতে, এটি বেদের সারাংশ বলে এর নাম ‘বেদান্ত’।

উপনিষদ্‌ অসংখ্য। বর্তমানে দুশোটিরও বেশি উপনিষদ্‌ পাওয়া যায়। বেদের বাইরেও উপনিষদের অস্তিত্ব আছে। আদি শঙ্কর দশটি উপনিষদ্‌কে প্রাচীনতম ও প্রামাণ্য (বৈদিক) উপনিষদ্‌ হিসেবে গ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে রামানুজ আরও এই তালিকায় আরও দুটি নাম অন্তর্ভুক্ত করেন। এই বারোটি উপনিষদ্‌ হল–(১) ঈশ বা ঈশাবাস্য, (২) কেন, (৩) কঠ, (৪) প্রশ্ন, (৫) মুণ্ডক, (৬) মাণ্ডুক্য, (৭) ঐতরেয়, (৮) তৈত্তিরীয়, (৯) ছান্দোগ্য, (১০) বৃহদারণ্যক, (১১) কৌষিতকী ও (১২) শ্বেতাশ্বেতর। আদি শঙ্করের রচনায় আরও চারটি বৈদিক উপনিষদের উল্লেখ পাওয়া যায়। এগুলি হল–(১) জাবাল, (২) কৈবল্য, (৩) মহানারায়ণ ও (৪) বজ্রসূচিকা। কেবল মাত্র এই উপনিষদ্‌গুলিই পরম সত্যের ব্যাখ্যা প্রদান করে বলে, হিন্দু সমাজের এগুলির গুরুত্ব এত বেশি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ভারতের জাতীয় নীতিবাক্য ‘সত্যমেব জয়তে’ (সত্যেরই জয় হয়) মাণ্ডুক্য উপনিষদ্‌ থেকে গৃহীত।

গীতা
শ্রীমদ্ভাগবদ্গীতা, বা সংক্ষেপে গীতা, হল হিন্দু মহাকাব্য মহাভারত-এর একটি অংশ। এটি মহাভারত-এর ধর্মালোচনা-মূলক অংশগুলির মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত। মহাভারত সম্পর্কে পরে আলোচনা করা হয়েছে। আপাতত এটুকুই জেনে রাখা যাক, মহাভারত-এর ভীষ্মপর্বের অন্তর্গত ২৫-৪২ অধ্যায়গুলি গীতা নামে পরিচিত। গীতা-য় ৭০০টি শ্লোককে আঠারোটি অধ্যায়ে বিন্যস্ত করা হয়েছে।

প্রশ্ন উঠবে, গীতা প্রস্থানত্রয়ের মধ্যে অন্যতম হিসেবে গণ্য হয় কেন? গীতা উপনিষদের সার। আর উপনিষদ্‌ শ্রুতিরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাই গীতার প্রামাণিকতাও বেদের সমতুল্য। তাই গীতাকে প্রস্থানত্রয় বা তিনটি প্রামাণিক শাস্ত্রগ্রন্থের একটি মনে করা হয়।

হিন্দু সমাজে গীতা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ধর্মগ্রন্থ। তার কারণ অবশ্যই এর বিষয়বস্তু। কুরুক্ষেত্র ময়দানে কৌরব-পাণ্ডবের যুদ্ধের ঠিক আগে কৃষ্ণ ও অর্জুনের মধ্যে ধর্ম বিষয়ে যে আলোচনা হয়েছিল, তা-ই গীতা-র সারবস্তু। অর্জুন যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁর গুরু, আত্মীয় ও প্রিয়জনেদের তাঁর বিপক্ষে দাঁড়াতে দেখে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। এমনকি এও বলেন যে, এঁদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ না হয়ে ভিক্ষে করে জীবন কাটানোই তাঁর পক্ষে শ্রেয়স্কর। কিন্তু তিনি তা করলে তো অধর্মাচারী দুর্যোধনই ধর্মের বিরুদ্ধে জয়লাভ করবে! কৃষ্ণ তখন অর্জুনকে মানুষকে নীতি ও কর্তব্য সম্পর্কে ধর্মের মূল বক্তব্যগুলি স্মরণ করিয়ে দিয়ে অর্জুনকে তাঁর কর্তব্যকর্মে উদ্বুদ্ধ করে তুললেন। এর পাশাপাশি গীতা-য় উপনিষদের সকল দার্শনিক ও নৈতিক শিক্ষাগুলির সারসংক্ষেপ লিপিবদ্ধ রয়েছে। একটি জনপ্রিয় শ্লোকে তাই উপনিষদ্‌কে গাভী, গীতা-কে দুধ, কৃষ্ণকে গোপালক ও অর্জুনকে গোবৎসের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। সর্বোপরি গীতা-য় মানবহৃদয়ের আশা-আকাঙ্ক্ষা, সংশয় ও প্রতিবন্ধকতা ইত্যাদি বিষয়গুলি গভীরভাবে ব্যাখ্যাত হয়েছে। গীতা-র উদ্দেশ্য হিন্দু সমাজে আদর্শ মানুষের সৃষ্টি করা। তাই গীতা-র যোগী হলেন ঈশ্বরের অবতারের মতো একাধারে ধ্যানী ও কর্মী–এক বাস্তববোধ-সম্পন্ন মরমিয়া সাধক, যাঁর মস্তিষ্ক ঈশ্বরে স্থিত এবং হাত সমাজে। স্বামী বিবেকানন্দ ঠিক এমনই এক কর্মী যোগীপুরুষের আদর্শ উদাহরণ।

গীতা-র মূল বক্তব্যটি স্বামী হর্ষানন্দ খুব সংক্ষেপে সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেন, “সকলকে নির্ভীক হয়ে নিঃস্বার্থ ত্যাগের ভাবে আপন আপন কর্তব্য সম্পাদন করতে হবে–তা সে কর্তব্য যতই কেন কঠিন বা অপ্রীতিকর হোক–এই হল গীতার মর্মবাণো। নারীপুরুষ নির্বিশেষে আমাদের প্রত্যেককেই নিজের কর্তব্য করে যেতে হবে। একেই বলে স্বধর্মপালন, এর উদ্দেশ্য ঈশ্বরের প্রসন্নতাবিধান, জগতের সেবা এবং তার সঙ্গে সঙ্গে সমাজের কাছে আমাদের যা ঋণ তা পরিশোধ করা।”

ব্রহ্মসূত্র

উপনিষদ্‌ ও গীতার কথা তো হল। এবার আসি ব্রহ্মসূত্র-এর কথায়। ব্রহ্মসূত্র উপনিষদ্‌ তথা বেদের অংশ নয় ; এটি উপনিষদের সামগ্রিক ব্যাখ্যা। ‘সূত্র’ বা ছোটো ছোটো শ্লোকের আকারে এই বইটি লেখা। লিখেছিলেন ঋষি বাদরায়ণ। এই বইয়ের প্রধান আলোচ্য বিষয় হল পরমব্রহ্মের সঙ্গে মানুষ ও জগতের সম্পর্ক। সেই জন্যই এর নাম ‘ব্রহ্মসূত্র’। আবার বেদান্তের বাণীকে একসূত্রে বাঁধে বলে এর অন্য নাম ‘বেদান্তসূত্র’। বইটি চারটি অধ্যায়ে বিভক্ত। প্রতিটি অধ্যায় আবার চারটি করে পদে বিভক্ত। পদগুলি লিখিত হয়েছে একাধিক অধিকরণ নিয়ে। প্রত্যেকটি অধিকরণ এক একটি সূত্রের আকারে লেখা।

সূত্রগুলি সাধারণ মানুষ যাতে বুঝতে পারে, তাই এগুলির একাধিক ভাষ্য লিখে গিয়েছেন পরবর্তীকালের দার্শনিক ও ধর্মতত্ত্ববিদেরা। এঁদের মধ্যে আদি শঙ্কর, রামানুজ ও মধ্বের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এঁদের রচনা থেকেই পরবর্তীকালে বেদান্তদর্শনের বিভিন্ন শাখাগুলির উদ্ভব ঘটে।




স্মৃতি

শ্রুতি হিন্দুধর্মের প্রধান প্রামাণ্য ধর্মগ্রন্থ। কিন্তু এটিই আমাদের একমাত্র প্রামাণ্য গ্রন্থ নয়। শ্রুতির ভিত্তিতে পরবর্তীকালে এক দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রামাণ্য ধর্মগ্রন্থরাজি রচিত হয়। এগুলি ‘স্মৃতি’ নামে পরিচিত। স্মৃতি হল হিন্দুদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক আদর্শ আচরণবিধি। সহজ কথায় বললে, ধর্মীয় আইনের বই। হিন্দু সমাজে যুগে যুগে যেসব আইন রচিত হয়েছে, সেগুলির সংকলনই হল স্মৃতি। স্মৃতি বেদের মতো অপৌরুষেয় নয় ; তা বেদকে ভিত্তি করে মানুষের দ্বারা রচিত–এ কথা স্মৃতি নিজেও স্বীকার করে নিয়েছে। আসলে স্মৃতির উদ্দেশ্য হল শ্রুতির আদর্শগুলিকে ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে প্রয়োগ করার উদ্দেশ্যে অনুশাসন জারি করা।

হিন্দু সমাজের তিন জন প্রধান আইন রচয়িতার নাম হল মনু, যাজ্ঞবল্ক্য ও পরাশর। এদের গ্রন্থের প্রধান আলোচ্য বিষয় হল ধর্ম অর্থাৎ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির নাগরিকদের কর্তব্য। তাই এই গ্রন্থগুলিকে বলা হয় ‘ধর্মশাস্ত্র’। এই বইগুলিতে সমাজের প্রতিটি শ্রেণির মানুষের দায়িত্ব ও কর্তব্য ব্যাখ্যার পাশাপাশি রাজার কর্তব্য, রাষ্ট্রীয় প্রশাসন, ফৌজদারি আইন, প্রাচীন কালের স্বাস্থ্যবিধি ও বিভিন্ন পাপের জন্য শাস্তিবিধানের উল্লেখ পাওয়া যায়।

তবে অপৌরুষেয় নয় বলে, স্মৃতিতে পরিবর্তন আনতে খুব একটা বাধা পেতে হয় না। বরং যুগের রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক ও আদর্শগত পরিবর্তনের সঙ্গে ধর্মজীবনকে খাপ খাওয়াতে এবং জাতীয় জীবনে উদ্ভুত নতুন সমস্যার সমাধান করতে স্মৃতিতে পরিবর্তন আনতেই হয়। এই পরিবর্তন অবশ্যই বেদকে অতিক্রম করে যায় না। শুধু প্রাচীন বিধিনিষেধগুলিকে বদলে, নতুন নিয়মকানুন চালু করা হয়। এর ফলে হিন্দুর জীবনযাত্রা ধর্মকে আঘাত না করেও যুগোপযোগী হয়ে ওঠে।ট হিন্দুধর্মের এও একটি বৈশিষ্ট্য। হিন্দুধর্ম স্থবির রক্ষণশীলের ধর্ম নয় ; হিন্দুধর্ম যৌবনের ধর্ম। হিন্দু সমাজ একটি জীবন্ত সংস্থা। তাই এর আইনগুলিও নমনীয়। তাই যুগের প্রয়োজনে পুরনো আইন বাতিল করে, আমরা নতুন আইন রচনা করতে দ্বিধা করি না। এমন কী নতুন ধর্মশাস্ত্র রচিত হলে, তাকেও হিন্দুধর্ম স্বীকার করে নেয়।

আমাদের মনে রাখা দরকারে, কত সাম্রাজ্যের উত্থান-পতন ও বিদেশী আক্রমণকারীর লুণ্ঠনকে সহ্য করে আজও সগৌরবে টিকে আছে হিন্দুধর্ম। ধর্মগ্রন্থ পুড়েছে, মন্দির ভেঙেছে, মানুষের প্রাণ গেছে–কিন্তু হিন্দু সমাজ অবলুপ্ত হয়নি। বরং যারা হিন্দুধর্মকে ধ্বংস করার জন্য একদা তলোয়ার উঠিয়েছিল, তাদের আশ্রয় হয়েছে ইতিহাসের বিস্মৃত কবরে। এর কারণ কী? এর কারণ এই যে, ঈশ্বর-নির্দেশিত সত্যকে উলঙ্ঘন না করেই চিরকাল যুগের প্রয়োজনের সঙ্গে আমরা আমাদের খাপ খাইয়ে নিতে পেরেছি। আমাদের সমাজ যদি কখনও সময়ের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে না পারত, যদি এই সমাজ কোনো দিন অগ্রণী মহামানবদের সংস্কারকে গ্রহণ করার সাহস না দেখাতে পারত, বা যদি শ্রুতিতে উল্লিখিত ঈশ্বর-কথিত ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব ও প্রেমের চিরন্তন বাণীকে নতুন আধারে গ্রহণ না করে কল্পনা ও সাহসকে পাথেয় করে এগিয়ে যাওয়ার স্পর্ধা না দেখাতে পারত, তবে হিন্দুদের দশা কবেই প্রাচীন গ্রিক বা রোমানদের মতো হয়ে যেত।

সুতরাং আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, স্মৃতিতে যে সব আইনগুলির কথা বলা হয়েছে, সেগুলি সবই শ্রুতির সনাতন আদর্শগুলির অধীনস্থ। স্মৃতির সঙ্গে শ্রুতির সম্পর্কটি অনেকটা দেহের সঙ্গে আত্মার সম্পর্কের মতো। দেহের বৃদ্ধি ও ক্ষয় আছে। কালের সঙ্গে সঙ্গে দেহের বিনাশ ঘটে। কিন্তু আত্মা অমর। ঠিক তেমনই কালের সঙ্গে সঙ্গে স্মৃতির ক্ষয়বৃদ্ধি ঘটে। কিন্তু শ্রুতি কালের উর্ধ্বে অবস্থান করে।



ইতিহাস ও পুরাণ

স্মৃতি ছাড়াও আরও কয়েকটি দ্বিতীয় পর্যায়ের ধর্মগ্রন্থ রয়েছে। এগুলি হল–(১) ইতিহাস, (২) পুরাণ, (৩) আগম ও (৪) দর্শন। কখনও কখনও বৃহত্তর অর্থে স্মৃতি বলতে এই সব কটি ধর্মগ্রন্থকেই বোঝায়। কারণ, স্মৃতির মতো এগুলিও পরিবর্তনশীল। শ্রুতি যদি ধর্মের আত্মা ও স্মৃতি যদি তার দেহ হয়, তবে এই গ্রন্থগুলি হল অঙ্গপ্রত্যঙ্গমাত্র।

এবার আসুন, ইতিহাস ও পুরাণ  নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করি।

ইতিহাস (রামায়ণ ও মহাভারত)

প্রথমেই আসি ‘ইতিহাস’ প্রসঙ্গে। ‘ইতিহাস’ কাকে বলে? আমাদের দুটি অতি-পরিচিত মহাকাব্য রামায়ণ ও মহাভারত হল ইতিহাস। রামায়ণ ও মহাভারত-এর গল্প আমরা সবাই কমবেশি জানি ; তাই এখানে তার আর পুনরুল্লেখ করা হল না। এই বইদুটি লেখার উদ্দেশ্য ছিল, নানা ঐতিহাসিক ও কিংবদন্তিকে অবলম্বন করে গল্পের মাধ্যমে বেদের সত্য ও স্মৃতির বিধানগুলিকে মানুষের মনে গেঁথে দেওয়া। এই সব বইতে আমরা যে মহৎ চরিত্রগুলি দেখতে পাই, তাদের জীবনদর্শনই এদেশের মানুষের মনের মধ্যে হিন্দুধর্মকে দৃঢ়ভাবে গেঁথে দিয়েছিল। এক কথায় বলা যায়, রামায়ণ ও মহাভারত ছিল বেদের এক জনপ্রিয় ভাষ্য। বেদে আছে যাগযজ্ঞের বিস্তারিত বিবরণ আর ব্রহ্মতত্ত্ব সম্পর্কে গুরুগম্ভীর আলোচনা। এসবের মর্ম সাধারণ মানুষ ঠিক বুঝতে পারত না। তাই বেদের সত্যগুলিকে সকলের বোধগম্য করে গেঁথে দেওয়া হল মহাকাব্যের মধ্যে। আজও হিন্দুদের ধর্ম সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞান হয় এই দুই মহাকাব্যের গল্প থেকে। রামায়ণ-রচয়িতা বাল্মীকি ও মহাভারত-কার ব্যাসদেবকে ঋষির মর্যাদা দেওয়া হয়। কারণ তাঁরা বেদের শিক্ষাগুলিকে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন। তাঁরা নিছক মহাকাব্য-রচনাকারী সাহিত্যিক ছিলেন না, তাঁরা ছিলেন জাতির স্রষ্টা। তাঁদের শিক্ষা হিন্দুরা আজও মেনে চলে।

রামায়ণ


রামায়ণের প্রধান নায়ক-নায়িকারা: (বাঁদিক থেকে) লক্ষ্মণ, রাম ও সীতা, (নিচে বসে আছেন) হনুমান।

মহর্ষি বাল্মীকি সংস্কৃত সাহিত্যে ‘আদি কবি’র মর্যাদা পেয়ে থাকেন। বাল্মীকির রামায়ণ-এ মোট ২৪,০০০ শ্লোক আছে। রামায়ণ মোট সাতটি কাণ্ড বা অংশে বিভক্ত। এগুলি হল–(১) বালকাণ্ড (বাংলায় আদিকাণ্ড), (২) অযোধ্যাকাণ্ড, (৩) অরণ্যকাণ্ড, (৪) কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ড, (৫) সুন্দরকাণ্ড, (৬) যুদ্ধকাণ্ড (বা লঙ্কাকাণ্ড) ও (৭) উত্তরকাণ্ড। রামায়ণ কয়েক হাজার বছর ধরে ভারতীয় তথা হিন্দু জীবন ও সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করে আসছে। প্রত্যেক হিন্দু শিশু জানে, রাম ছিলেন আদর্শ রাজা, সীতা ছিলেন আদর্শ স্ত্রী, লক্ষ্মণ ও হনুমান ছিলেন আনুগত্য, ভক্তি ও শৃঙ্খলাপরায়ণতার আদর্শ উদাহরণ। হিন্দুর ধর্ম, সংস্কৃতি, সাহিত্য, নাটক, সংগীত, শিল্পকলা, স্থাপত্য সর্বত্রই ছড়িয়ে আছে রামায়ণ-কথার অজস্র প্রতিফলন।

মহাভারত

রামায়ণ ছাড়া হিন্দুদের আছে মহাভারত। মহাভারত হিন্দুধর্মের বিশ্বকোষ। কুরুবংশের দুটি শাখা পাণ্ডব ও কৌরবদের গৃহবিবাদ এই উপাখ্যানের মূল উপজীব্য। কিন্তু এতে আছে দীর্ঘ উপন্যাস, সংলাপ, ধর্মালোচনা ও উপদেশমালা। বিষয়বৈচিত্র্যের জন্য একে বলা হয় ‘পঞ্চম বেদ’। হিন্দুধর্মের এমন কোনো বিষয় নেই, যা মহাভারত-এ আলোচিত হয়নি। মহাভারত-এর কেন্দ্রীয় চরিত্র অবশ্যই কৃষ্ণ। তাঁর হাতেই রয়েছে এই বিরাট মহাকাব্যের সব কিছুর চাবিকাঠি। তিনি একাধারে এক মহান গুরু, দার্শনিক ও কর্মযোগী। হিন্দুধর্মের শ্রেষ্ঠ সন্তান হলেন এই কৃষ্ণই। কৃষ্ণের পরেই আসে পাণ্ডব ভাইদের কথা। বিশেষ করে প্রথম পাণ্ডব যুধিষ্ঠিরের কথা। তিনি যুদ্ধ ও শান্তির ক্ষেত্রে স্বয়ং হিন্দুধর্মেরই প্রতীক। হিন্দুধর্মের আরেক তাত্ত্বিক নেতা হলেন এই মহাকাব্যের অন্যতম প্রধান চরিত্র প্রাচীন যোদ্ধা ভীষ্ম। শান্তিপর্বে লিপিবদ্ধ তাঁর উপদেশ-সম্বলিত দীর্ঘ-সংলাপটি কোনো অংশে কম জনপ্রিয় নয়।


ব্যাসদেবকে মহাভারত লিপিবদ্ধ করতে সাহায্য করছেন গণেশ।

মহাভারত আঠারোটি পর্ব বা অংশে বিভক্ত। এগুলির নাম হল–(১) আদি, (২) সভা, (৩) বন, (৪) বিরাট, (৫) উদ্যোগ, (৬) ভীষ্ম, (৭) দ্রোণ, (৮) কর্ণ, (৯) শল্য, (১০) সৌপ্তিক, (১১) স্ত্রী, (১২) শান্তি, (১৩) অনুশাসন, (১৪) অশ্বমেধ, (১৫) আশ্রমিক, (১৬) মৌষল, (১৭) মহাপ্রাস্থনিক ও (১৮) স্বর্গারোহণ। মহাভারত-এ এক লক্ষেরও বেশি শ্লোক আছে।

ভারতের বিভিন্ন ভাষায় রামায়ণ ও মহাভারত অনূদিত হয়েছে। হিন্দুদের ধর্মশিক্ষার বেশিরভাগটাই এই সব অনুবাদ গ্রন্থ থেকে হয়ে যায়। বাংলা ভাষায় রামায়ণ-এর প্রধান অনুবাদক কৃত্তিবাস ওঝা এবং মহাভারত-এর প্রধান অনুবাদক কাশীরাম দাশ। দুজনেই আমাদের পশ্চিমবঙ্গের মানুষ–কৃত্তিবাস ওঝা নদিয়া জেলার ও কাশীরাম দাশ বর্ধমান জেলার বাসিন্দা ছিলেন। এঁরা পদ্যে রামায়ণ ও মহাভারত অনুবাদ করেন। গদ্যেও একাধিকবার এই দুই মহাকাব্য বাংলায় অনূদিত হয়েছে। এছাড়াও রামায়ণ ও মহাভারত অবলম্বনে রচিত হয়েছে অধ্যাত্ম রামায়ণ, যোগবাশিষ্ট রামায়ণ, জৈমিনি-ভারত প্রভৃতি সংস্কৃত আখ্যান।



পুরাণ


হিন্দুপুরাণের সৃষ্টিতত্ত্ব সম্পর্কে একটি রূপক চিত্র। ১৮২৮ সালে অঙ্কিত শিবপুরাণের অলংকরণ।

দর্শন গ্রন্থগুলির অপর দিকে রয়েছে পুরাণ ও আগম শাস্ত্র। শ্রুতিশাস্ত্রে যে সত্য বর্ণিত হয়েছে, তা-ই রাজারাজড়াদের অভিযান কাহিনি, দেবদেবীদের গল্প ও সাধুপুরুষদের কিংবদন্তির মাধ্যমে সরল ও মনোরম ভাষায় সাধারণ মানুষের বোধগম্য করে তোলে ‘পুরাণ’। বৈদিক যুগের পরবর্তীকালের ধর্মগুরুরা পুরাণের গল্পগুলি লোকশিক্ষার কাজে ব্যবহার করতেন। পুরাণ থেকে আমরা অনেক সুন্দর সুন্দর গল্প জানতে পারি। এই গল্পগুলির কয়েকটির পিছনে কিছু ঐতিহাসিক ভিত্তি থাকলেও, অধিকাংশই কাল্পনিক। এগুলিকে বলা চলে একধরনের ঐতিহাসিক রূপক কাহিনি। ঐতিহাসিক নাটক বা উপন্যাসে ঐতিহাসিক সত্য ঘটনা ও গল্পের মধ্যে একটা সামঞ্জস্যবিধান ঘটানো হয়, এখানেও ঠিক সেই রকমই করা হয়ে থাকে। আসলে হিন্দু ধর্মগ্রন্থের মূল লক্ষ্যটি হল ঈশ্বরীয় সত্যটিকে  প্রকাশ করা, ঐতিহাসিক সত্যটিকে নয়। তাই ঈশ্বরীয় সত্যের প্রামাণ্যতা ঐতিহাসিক সত্যের মাপকাঠিতে বিচার করা যায় না। হিন্দুপুরাণের বিষ্ণুর অবতার কাহিনিগুলিতে এই বিষয়টি খুব স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। ঈশ্বর যে তাঁর সাহায্যপ্রার্থী আর্ত ও পীড়িতকে কখনই বিমুখ করেন না, তারই একটি রূপক বিবরণ দেওয়া হয়েছে এই গল্পগুলিতে। হিন্দুধর্মে এই অবতার-কাহিনিগুলি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ ও ঈশ্বরের মধ্যে প্রেমময় সম্পর্কের কথা এই কাহিনিগুলির চেয়ে ভাল আর কেউই শিক্ষা দিতে পারে না। অবতার হলেন ঈশ্বরের ঈশ্বরের একটি বিশেষ রূপ। ঈশ্বর যখন সশরীরে পৃথিবীতে নেমে আসেন, তখন আমরা তাঁকে বলি অবতার। ঈশ্বর নেমে আসেন কেন? শ্রীকৃষ্ণ গীতায় একটি শ্লোকের মাধ্যমে এর সুন্দর ব্যাখ্যা দিয়েছেন, “হে অর্জুন, যখনই ধর্মের ক্ষয় হয় এবং অধর্মের বাড়বৃদ্ধি ঘটে, আমি সশরীরে নেমে আসি। ভাল লোকেদের ভাল করার জন্য, দুষ্টু লোকেদের খতম করার জন্য এবং ধর্মকে পুনরায় প্রতিষ্ঠা করার জন্য আমি যুগে যুগে জন্ম নিই।”


হিন্দু পুরাণের একটি জনপ্রিয় গল্প – সমুদ্রমন্থন।

প্রধান পুরাণের সংখ্যা আঠারোটি। এগুলিকে মহাপুরাণ বলা হয়। এগুলি হল–(১) ব্রহ্ম, (২) পদ্ম, (৩) বিষ্ণু, (৪) শিব বা বায়ু, (৫) ভাগবত, (৬) নারদীয়, (৭) মার্কণ্ডেয়, (৮) আগ্নেয়, (৯) ভবিষ্য বা ভবিষ্যৎ, (১০) ব্রহ্মবৈবর্ত, (১১) লিঙ্গ, (১২) বরাহ, (১৩) স্কন্দ, (১৪) বামন, (১৫) কূর্ম, (১৬) মৎস্য, (১৭) গরুড় ও (১৮) ব্রহ্মাণ্ড। এছাড়া আরও কয়েকটি অপ্রধান পুরাণ রয়েছে। এগুলিকে বলে উপপুরাণ। মহাপুরাণগুলির মধ্যে বিষ্ণুপুরাণ ও ভাগবত পুরাণ অত্যন্ত জনপ্রিয়। ভাগবত পুরাণ বা শ্রীমদ্ভাগবত এতই গুরুত্বপূর্ণ একটি ধর্মগ্রন্থ যে এটিকে রামায়ণ ও মহাভারত-এর সম মর্যাদা দেওয়া হয়। উপপুরাণগুলির মধ্যে বৃহন্নন্দীশ্বর, কালিকা, বিষ্ণুধর্মোত্তর, বামন, নারসিংহ, বৃহদ্ধর্ম, বৃহন্নারদীয়, নন্দিকেশ্বর, দেবী ও দেবী-ভাগবত পুরাণের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অমরকোষ ও অন্যান্য প্রাচীন হিন্দু বিশ্বকোষগুলির মতে, পুরাণগুলি ‘সর্গ’ (সৃষ্টিবৃত্তান্ত), ‘প্রতিসর্গ’ (প্রলয়ের পর নতুন সৃষ্টির বৃত্তান্ত), ‘বংশ’ (দেবতা ও ঋষিদের বংশলতিকা), ‘মন্বন্তর’ (এক এক মনুর শাসনকাল) ও ‘বংশানুচরিত’ (রাজবংশগুলির ইতিহাস)–প্রধানত এই পাঁচ রকম উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত। অবশ্য পুরাণগুলিতে এই পাঁচ উপাদান ছাড়া অন্যান্য অনেক উপাদানের কথাও বলা হয়েছে।

আমাদের পরিসর ক্ষুদ্র ; তাই আঠারোটি পুরাণ নিয়ে দীর্ঘ আলোচনার অবকাশ নেই। কিন্তু ভাগবত পুরাণ এবং অবতার-প্রসঙ্গে সম্পর্কে একটু আলোকপাত না করলে এই রচনা অসম্পূর্ণই থেকে যাবে। এই পুরাণের গুরুত্ব গীতা-র তুলনায় কিছুমাত্র কম নয়। বিশেষত ভক্তিবাদী বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মধ্যে এই পুরাণের স্থান অতি উচ্চে। তবে এই পুরাণ শুধুমাত্র ভক্তিশাস্ত্র নয়। ভাগবত-এ জ্ঞান ও ভক্তির সার্থক ঐক্যবিধান করা হয়েছে।


ভাগবত পুরাণে বর্ণিত হয়েছে কৃষ্ণের সম্পূর্ণ জীবনকথা।

ভাগবত পুরাণ বিরাট বই। এটি বারোটি স্কন্ধ বা অংশে বিভক্ত। মোট শ্লোকসংখ্যা ১২০০০। এর মধ্যে দশম ও একাদশ স্কন্দের বিষয়বস্তু হল ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জীবনকথা। মহাভারত-এ যেমন গীতা, তেমনি ভাগবত-এ আছে উদ্ধব গীতা। দেহত্যাগের আগের সন্ধ্যায় শ্রীকৃষ্ণ তাঁর প্রিয় শিষ্য ও ভক্ত উদ্ধবকে নানা আধ্যাত্মিক বিষয় শিক্ষা দিয়ে যান। এই অংশটিই উদ্ধব গীতা নামে পরিচিত।

ভাগবত-এ বলা হয়েছে যে, অবতারের সংখ্যা অনেক। তবে হিন্দুধর্মে দশ জন অবতার সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। এঁরা হলেন–(১) মৎস্য, (২) কূর্ম, (৩) বরাহ, (৪) নৃসিংহ, (৫) বামন, (৬) পরশুরাম, (৭) রাম, (৮) কৃষ্ণ, (৯) বুদ্ধ ও (১০) কল্কি। এঁদের মধ্যে কেউ পুরোপুরো পৌরাণিক চরিত্র, কেউ কিংবদন্তির মানুষ, কেউ বা ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব। শেষ জন অর্থাৎ কল্কি অবতার তো এখনও জন্মগ্রহণই করেননি ; তাঁর আবির্ভাব সম্পর্কে ভবিষ্যদবাণীই শুধু করা হয়েছে।

দশাবতারের এই তালিকায় বুদ্ধের নাম দেখে কেউ কেউ বিস্মিত হন। বুদ্ধ তো সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি ধর্মমতের প্রতিষ্ঠাতা। তাহলে বুদ্ধ কিভাবে অবতারের মর্যাদা পান? প্রসঙ্গত বলে রাখা ভাল, ভিন্ন ধর্মের প্রবর্তক বলেই কারোর নিন্দাবাদ করা ধর্মীয় সংকীর্ণতার লক্ষণ। বুদ্ধ মানবজাতির অন্যতম শ্রেষ্ঠ গুরু। হিন্দুধর্ম ও বৌদ্ধধর্মের মধ্যে মতবাদগত কিছু অমিল থাকলেও, হিন্দুরা বুদ্ধের উপদেশকে মানুষের হিতকর বলেই মনে করেন। তাই তাঁর ধর্মমতের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে অবতারের মর্যাদা দেওয়া হয়। জয়দেব তাঁর বিখ্যাত ‘গীতগোবিন্দম্‌’ কাব্যের দশাবতার স্তোত্রে বুদ্ধের সর্বজীবে দয়া, অহিংসা ও জীবহত্যার বিরোধিতাকে তাঁর অবতারত্বের চিহ্ন হিসেবে প্রকাশ করেছেন। অবশ্য তার অর্থ এই নয় যে, বৌদ্ধধর্ম বৈষ্ণব বা শাক্ত মতবাদের মধ্যে হিন্দুধর্মের একটি শাখা। বৌদ্ধধর্ম হল হিন্দুধর্ম থেকে উৎসারিত একটি পৃথক ধর্ম। যদিও হিন্দু ও বৌদ্ধধর্মের অনেক আদর্শই আশ্চর্যজনকভাবে একই। বুদ্ধ নিজেও আজীবন ছিলেন হিন্দু। তিনি নিজেকে ধর্মপ্রবর্তক মনে না করে ধর্মসংস্কারক মনে করতেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও বৌদ্ধধর্মকে আলাদা ধর্মমত মনে করা হয়, তার কারণ একটিই–বৌদ্ধধর্ম বেদের কর্তৃত্বকে মেনে নেয় না। কিন্তু বুদ্ধের শিক্ষার মহত্ব এখানেই যে, এত বড়ো বিচ্যূতি সত্ত্বেও হিন্দুরা তাঁর অহিংসা ও জীবে দয়ার আদর্শটির জন্যই তাঁকে অবতারের মর্যাদা দেন। এটি হিন্দুধর্মের উদার ও মানবতাবাদী চরিত্রের আরও একটি বড়ো উদাহরণ বলতে হবে।

কিন্তু অবতারেরা কী শুধু ভারতেরই ত্রাণের জন্য আসেন? অবশ্যই তা নয়। তাঁরা আসেন, সমগ্র মানবজাতির উদ্ধারের জন্য। তাই জন্যই তো অবতার কাহিনিতে কোনো নির্দিষ্ট জাতি বা ভৌগোলিক ভুখণ্ডের প্রতি তাঁদের পক্ষপাতিত্বের উল্লেখ থাকে না। তাঁরা আসেন সসাগরা পৃথিবীকে উদ্ধার করার জন্য। আর তাঁরা যেমন অতীতে এসেছিলেন, তেমনি আসবেন ভবিষ্যতেও।


শ্রীশ্রীচণ্ডীতে বর্ণিত দেবী ও অসুরগণের যুদ্ধ।

পুরাণ আলোচনার সময় মার্কণ্ডেয়পুরাণ-এর অন্তর্গত দেবীমাহাত্ম্যম্‌ বা শ্রীশ্রীচণ্ডী-র কথা উল্লেখ করতেই হয়। এটি শাক্ত হিন্দুদের নিকট অতিপবিত্র একটি ধর্মগ্রন্থ। হিন্দু পূজাপার্বণে, বিশেষত দুর্গাপূজায়, চণ্ডীপাঠ একটি প্রয়োজনীয় আনুষঙ্গিক অনুষ্ঠান।

পুরাণ আমাদের শিক্ষা দেয় যে, ঈশ্বর অবলুপ্ত হন না। তিনি মানুষকে ভালবাসাও ত্যাগ করেন না। কোনো জাতি বা কোনো দেশের প্রতি তিনি পক্ষপাতিত্ব করেন না। বরং যখনই মানবজাতির তাঁকে প্রয়োজন হয়, তিনি তাঁর দয়ার্দ্র হৃদয়টি নিয়ে সব সময় আমাদের পাশে এসে হাজির হন। এমনকি পুরাণে একজন ভাবী অবতারের ভবিষ্যদবাণীও করা হয়েছে। এর কারণ, হিন্দুধর্ম শুধুমাত্র অতীত-বিলাসী বা অকারণ অতীত-বিদ্বেষী কোনোটাই নয়। তাই আজও এই ভারতভূমিতে অবতারেরা জন্ম নেন। সর্বশেষ অবতার বুদ্ধের জীবপ্রেম ও অহিংসার বাণীকে পাথেয় করে সনাতন হিন্দুধর্মের নূতনতর ব্যাখ্যা আমাদের সামনে উপস্থিত করেন। আর তাই আজও পুরাণতুল্যের ধর্মসাহিত্যের সৃষ্টি হওয়া কিছুই অসম্ভব নয়।

পুরাণের বিষয়বস্তু আলোচনা করতে করতে আমরা হিন্দুধর্মের গভীরে চলে গিয়েছি। কিন্তু বর্তমান নিবন্ধে আমাদের উদ্দেশ্য প্রধান প্রধান হিন্দু ধর্মশাস্ত্রগুলির একটি রূপরেখা প্রধান। তাই আবার মূল আলোচনায় ফিরে আসা যাক।



আগম

পুরাণের কথা শেষ করে চলে আসি আগমের কথায়। ‘আগম’ শব্দটির আক্ষরিক অর্থ ‘শাস্ত্র’। বেদের অপর নাম ‘আগম’। তবে হিন্দুধর্মে এই শব্দটির প্রয়োগ হয় অন্য একটি সংকীর্ণ অর্থেও। ‘আগম’ বলতে বোঝায়, ঈশ্বরের একটি নির্দিষ্ট রূপের উপাসনা ও সেই সম্পর্কিত বিষয় এবং সেই নির্দিষ্ট রূপের পূজকদের উপসাম্প্রদায়িক মতবাদ। আগমের অপর নাম হল ‘সাধনশাস্ত্র’। কারণ, আগমের প্রধান আলোচ্য বিষয় হল পূজা, উপাসনা ইত্যাদি।


বৈষ্ণব আগমের প্রধান দেবতা বিষ্ণু।

উপনিষদের মতোই আগমের সংখ্যাও অনেক। তবে এগুলিকে ঈশ্বরের তিনটি রূপ–বিষ্ণু, শিব ও মহাশক্তির উপাসনার ভিত্তিতে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। এই তিনটি শ্রেণি হিন্দুধর্মের প্রধান তিনটি শাখার জন্ম দিয়েছে। এগুলির নাম হল–(১) বৈষ্ণবধর্ম, (২) শাক্তধর্ম ও (৩) শৈবধর্ম। প্রতিটি আগমের চারটি অংশ। এগুলি হল–(১) দর্শন, (২) মনঃসংযম, (৩) মন্দির ও প্রতিমা নির্মাণের নিয়মাবলি ও (৪) ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান বা সাধনমার্গের বর্ণনা। এগুলি মোটামুটি নিয়মতান্ত্রিক ব্যাপার। তবে আগমকে ঘিরে ভারতের বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় যেসব ভক্তিমূলক কাব্যের সৃষ্টি হয়েছে সেগুলিই আগমের আসল গুরুত্বের নির্ধারক। এর থেকেই প্রমাণিত হয় যে, আগম ধর্মকে সাধারণ মানুষের ঘরের বস্তু করে তুলেছিল। বাংলা ভাষায় বৈষ্ণব পদাবলি, রামপ্রসাদ-কমলাকান্তের শাক্ত পদাবলি গান ইত্যাদি এই জাতীয় সাহিত্যের প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

পঞ্চরাত্র-সংহিতা

‘বৈষ্ণব-আগম’ বা ‘পঞ্চরাত্র-সংহিতা’-য় ঈশ্বরের মাহাত্ম্য বিষ্ণুর নানা রূপ ও নামের কীর্তন করা হয়। পঞ্চরাত্র-সংহিতার সংখ্যা ২১৫। তার মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বই হল–(১) ঈশ্বর, (২) পৌষ্কর, (৩) পরম, (৪) সাত্বত, (৫) বৃহৎব্রহ্ম ও (৬) জ্ঞানামৃত-সার-সংহিতা।

শৈব আগম


শৈব আগমের প্রধান দেবতা শিব।

ঠিক একইভাবে ‘শৈব-আগমে’ ঈশ্বর শিবের নাম ও রূপের মাধ্যমে আরাধিত হন। শৈব-আগমগুলি ‘শৈবসিদ্ধান্ত’ নামে এক অত্যন্ত উচ্চমানের দার্শনিক শাখার জন্মদাতা। শৈব আগমের সংখ্যা ২৮টি। এগুলির আবার কয়েকটি উপাগমও আছে। তবে এখন এগুলির মধ্যে মাত্র কুড়িটির কিছু কিছু অংশ পাওয়া যায়।

তন্ত্র


মহাশক্তিরূপিণী দুর্গা। শাক্ত আগম ঈশ্বরকে মাতৃরূপা পূজার কথা বলে।

‘শাক্ত-আগম’ বা তন্ত্র ঈশ্বরকে আদ্যাশক্তি বা মাতৃরূপে চিন্তা করার উপদেশ দেয়। তন্ত্রে আদ্যাশক্তিকে বিভিন্ন মূর্তি বা প্রতীকে পূজা করার কথা বলা হয়েছে। তন্ত্রগুলি রচিত হয়েছে শিব ও পার্বতীর কথোপকথনের আদলে। কোথায় প্রশ্নকর্তা পার্বতী ও উত্তরদাতা শিব ; কোথায় প্রশ্নকর্তা শিব ও উত্তরদাতা পার্বতী। প্রথম প্রকারের তন্ত্রকে বলে ‘আগম’ এবং শেষের প্রকারের তন্ত্রকে বলে ‘নিগম’। তন্ত্রের সংখ্যাও অনেক। তারমধ্যে ৬৪টি তন্ত্র খুবই প্রসিদ্ধ। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটির নাম হল–(১) মহানির্বাণ, (২) কুলার্ণব, (৩) কুলসার, (৪) প্রপঞ্চসার, (৫) তন্ত্ররাজ, (৬) রুদ্রযামল, (৭) ব্রহ্মযামল, (৮) বিষ্ণুযামল ও (৯) তোড়লতন্ত্র।

প্রশ্ন উঠবে, আগম কী শ্রুতির ভিত্তিতে রচিত? অবশ্যই, শ্রুতিকে অস্বীকার করে কোনো গ্রন্থই প্রামাণ্য শাস্ত্রের মর্যাদা লাভ করতে পারে না। কয়েকটি বই অবশ্য বেদ-বহির্ভুত অবস্থায় লেখা হয়। কিন্তু সেই বইয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ধর্মসম্প্রদায়টি যেই হিন্দুধর্মে প্রবেশ করল, অমনি বেদ সেগুলির উপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করল। বৈদিক ধারণায় স্নাত হওয়ার পর সেই সব বইয়ের প্রামাণ্যতাও স্বীকার করে নেওয়া হল। বৈষ্ণব গুরু যমুনাচার্য বেদের সঙ্গে বৈষ্ণব আগমগুলির সম্পর্ক আলোচনা করে প্রমাণ করেন যে, বৈষ্ণব আগমও মানসিকতার দিক থেকে বেদ-অনুসারী ; সুতরাং প্রামাণ্য। শৈব টীকাকার শ্রীকান্ত বলেছেন, “বেদ ও শৈব আগমগুলির মধ্যে আমরা কোনো পার্থক্য দেখি না।” শৈব শাস্ত্রকার মেয়কন্ডরও বলেছেন, “(শৈব) আগমগুলি বিশেষভাবে এবং ঈশ্বরের কৃপাধন্যদের জন্য রচিত ; এগুলিতে বেদ ও বেদান্তের মূল সত্যগুলি নিহিত রয়েছে।” তাই নিঃসন্দেহে বলা যায়, উপাসনার পদ্ধতি ও উপাস্যের রূপ নিয়ে আগমগুলির মধ্যে যতই পার্থক্য থাকুক না কেন, এগুলি চরিত্রগতভাবে পুরোপুরিই বৈদিক।

এখানে একটি ব্যাপারও লক্ষণীয়। আগম রচনাকারী কয়েকটি সম্প্রদায় পরবর্তীকালে হিন্দুধর্মে প্রবেশ করেছিল। তবে কী তারা হিন্দুধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছিল? হ্যাঁ, মূল ব্যাপারটা তাই। তবে হিন্দুধর্মের ধর্মান্তর তরবারির জোরে বা পরধর্মের নিন্দা করে হয় না। হিন্দুধর্ম কালে কালে একাধিক সম্প্রদায়কে অঙ্গীভূত করে তাদের ধর্মের চরিত্রকে বদলে দিয়েছিল। কিন্তু আদি ধর্মগুলির লোকাচার, আচার-অনুষ্ঠানগুলিকে ধ্বংস করেনি।



ষড়দর্শন

সব শেষে আসি দর্শন প্রসঙ্গে। দর্শনগুলিও শ্রুতির ভিত্তিতেই রচিত। দর্শনের প্রতিটি শাখায় বেদের বিভিন্ন অংশের শিক্ষাকে সুসংহত রূপ দেওয়া হয়েছে। বৈদিক সত্যগুলিকে পুরাণে কল্পনা এবং আগমে হৃদয়াবেগের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। কিন্তু দর্শনে তার প্রতিষ্ঠা হয়েছে যুক্তিও ভিত্তিতে।


প্রাচীন ভারতে দর্শনচর্চা।

দর্শনশাস্ত্রে আলোচিত হয়েছে জগতের উদ্ভব এবং ঈশ্বর ও আত্মা সম্পর্কে মৌলিক প্রশ্নগুলি। দর্শনের সংখ্যা ছয়। এগুলিকে তাই বলে ‘ষড়দর্শন’। এগুলির নাম হল–(১) ন্যায়, (২) বৈশেষিক, (৩) সাংখ্য, (৪) যোগ, (৫) পূর্ব-মীমাংসা ও (৬) উত্তর-মীমাংসা বা বেদান্ত। তবে পারস্পরিক বিষয়গত সাদৃশ্যের ভিত্তিতে এগুলিকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। এগুলি হল–(১) ন্যায়-বৈশেষিক, (২) সাংখ্য-যোগ ও (৩) মীমাংসা-বেদান্ত।

ন্যায়দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা অক্ষপাদ গৌতম। তাঁর ন্যায়সূত্র এই দর্শনের প্রধান গ্রন্থ। এই গ্রন্থে দুটি অংশে মোট পাঁচটি অধ্যায় আছে। মোট সূত্রের সংখ্যা ৫২৮। ১২০০ খ্রিস্টাব্দে গণেশ তত্ত্বচূড়ামণি নামে ন্যায়ের যে ভাষ্য রচনা করেন, তাকে ভিত্তি করে গড়ে ওঠে এই দর্শনের এক আধুনিক শাখা। এই শাখাটি নব্যন্যায় নামে পরিচিত। আমাদের পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার নবদ্বীপ ছিল নবন্যায় চর্চার প্রধান কেন্দ্র।

বৈশেষিক দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা উলূক কনাদ এবং এই দর্শনের কেন্দ্রীয় গ্রন্থ হল তাঁর লেখা বৈশেষিক সূত্র। এই বইতে মোট দশটি অধ্যায় আছে। প্রতিটি অধ্যায় আবার দুটি আহ্নিক বা অংশে বিভক্ত। মোট সূত্রের সংখ্যা ৩৭৪।

মহর্ষি কপিল সাংখ্য দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা। এই দর্শনের প্রধান গ্রন্থ কপিলের সাংখ্যসূত্র। এতে মোট ছ-টি অধ্যায় ও ৫২৬টি শ্লোক আছে।

যোগদর্শনের প্রতিষ্ঠাতা পতঞ্জলি তাঁর দর্শনের কথা যোগসূত্র গ্রন্থে সূত্রাকারে লিখে গিয়েছেন। এটি যোগবিজ্ঞানের সবচেয়ে প্রামাণ্য ও সুসংবদ্ধ প্রাচীন গ্রন্থ। চারটি অধ্যায়ে ১৯৫টি সূত্রের মাধ্যমে যোগের কথা এই বইতে বর্ণিত হয়েছে। উক্ত চারটি অধ্যায়ের বিষয়বস্তু হল–(১) সমাধি, (২) সাধনা, (৩) বিভূতি ও (৪) কৈবল্য।

দর্শন-প্রবর্তক জৈমিনির মীমাংসা-সূত্র এই দর্শনের প্রধান গ্রন্থ। এটি বেশ বড়ো বই। এতে বারোটি অধ্যায় ও ৬০টি উপ-অধ্যায়ে মোট ২৫০০ সূত্র ধরা আছে।

বেদান্তদর্শনের প্রধান গ্রন্থ হল প্রস্থানত্রয় ; যার কথা আগেই বলা হয়েছে।

প্রত্যেক দর্শনে সংশ্লিষ্ট দর্শনের প্রবর্তক কয়েকটি সূত্রের মাধ্যমে নিজের তত্ত্বটি খাড়া করেছেন। পরবর্তীকালে এই সূত্রগুলির প্রামাণ্য ভাষ্য রচিত হয়। তারপর সেই ভাষ্যের উপরেও একাধিক টীকা ও ভাষ্য রচিত হয়।


পাশ্চাত্যে বেদান্ত দর্শনকে প্রথম জনপ্রিয় করে তোলেন স্বামী বিবেকানন্দ।

প্রতিটি দর্শনের গুরুত্ব সবসময় এক রকম নয়। বেদান্ত দর্শন আধুনিক যুগের পক্ষে সবচেয়ে উপযোগী। এই দর্শন খোদ উপনিষদ্‌ থেকে উৎসারিত। তিনটি কারণে আমরা একে আধুনিক যুগের পক্ষে সবচেয়ে উপযোগী বলতে পারি। এগুলি হল–(১) এটি ব্যক্তিবিশেষের যুক্তিকে সঠিকভাবে বৈদিক সত্যের অধীনস্থ করে ; (২) বেদের বিভিন্ন অংশের আপেক্ষিক উপযোগিতা সম্পর্কে এটি একটি সঠিক ধারণা প্রদান করে এবং (৩) ধর্মপ্রাণ মানুষের মনে যে সব কঠিন প্রশ্নগুলি জাগে, সেগুলির সবচেয়ে সন্তোষজনক উত্তর একমাত্র এই শাখাটিই দিতে পারে। ব্যক্তিবিশেষের যুক্তিকে সর্বদাই বৈদিক সত্যের নিচে রাখতে হয়। কারণ, এক এক জন ব্যক্তির যুক্তি এক এক প্রকার হতে বাধ্য। আর তাকে বৈদিক সত্যের উপর স্থান দিলে সুসংগঠিত ধর্ম বলে আর কিছুই থাকবে না, পারস্পরিক ঝগড়াবিবাদেই সব নষ্ট হয়ে যাবে। তাছা প্রত্যক্ষকরণ, সিদ্ধান্ত ইত্যাদি জ্ঞানার্জনের মানবিক উপায়গুলি জাগতিক বিষয় সম্পর্কেই আমাদের শেখায়। ঈশ্বর এসবের উর্ধ্বে। তাই তাঁর প্রকৃতি জানতে হলে আমাদের যুক্তিবোধ ও অনুভূতিগুলিকে অন্য একটি প্রামাণিক সাক্ষ্যের সাহায্য নিতে হয়। বেদের প্রামাণিক সাক্ষ্যকে বলে ‘শব্দ’। ধর্মের ক্ষেত্রে তিনটি প্রামাণিক সাক্ষ্য রয়েছে। এগুলিকে বলে ‘প্রমাণ’। এই প্রমাণগুলি হল প্রত্যক্ষকরণ, সিদ্ধান্ত ও শাস্ত্র। ‘প্রমাণ’ হিসেবে বেদ ব্যক্তিনিরপেক্ষ, স্বাধীন ও চিরন্তন। তাই সাধারণ ব্যক্তিগত যুক্তিকে এর নিচেই রাখতে হয়। প্রত্যক্ষরণ ও সিদ্ধান্ত জাগতিক জ্ঞান অর্জনের উপায় ; তাই এগুলি দ্বিতীয় স্তরের প্রমাণ। তাদের কাজ শুধুমাত্র বৈদিক সত্যকে স্পষ্ট ও বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা।

তবে কী বেদ নিজস্ব মতামত একতরফাভাবে আমাদের উপর চাপিয়ে দেয়? তা মোটেই নয়। বরং আদি শঙ্কর বলেন যে, বেদের ব্রহ্মজ্ঞান চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছায় ব্যক্তিগত আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার মাধ্যমেই। যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের অভিজ্ঞতা বেদের অনুসারী, ততক্ষণই তা প্রামাণ্য। আমাদের মনে রাখতে হিন্দুর ধর্মবিশ্বাস কোনো বিশেষ ধর্মীয় ঐতিহ্যের একনায়কসুলভ কর্তৃত্ব, কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ বা কোনো একজন মানুষের মুখের কথার উপর দাঁড়িয়ে নেই ; বরং যাঁরা ঈশ্বর-নির্দিষ্ট পথে চলে ঈশ্বরের অস্তিত্ব উপলব্ধি করেন, তাঁদের অভিজ্ঞতালব্ধ প্রমাণই হিন্দুধর্মের মূল ভিত্তি।

তবে কী অন্য পাঁচটি দর্শনশাখা তিন ‘প্রমাণ’ মানে না? মানে। তত্ত্বগতভাবে তারাও বেদের কর্তৃত্ব মেনে নেয়। কিন্তু এই দর্শনগুলির শিক্ষার সঙ্গে বৈদিক শিক্ষার কিছু পার্থক্য রয়ে গিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, মীমাংসা দর্শন সর্বোচ্চ ধর্মগ্রন্থের প্রামাণিক সাক্ষ্য প্রস্তুতিকরণে অনেক দূর গিয়েছে, কিন্তু বেদের সকল অংশের আপেক্ষিক গুরুত্ব সম্পর্কে সঠিক ধারণা দিতে পারেনি। তাই বেদান্ত দর্শন এর উপরে স্থান পেয়েছে।

আমরা অনেকক্ষণ ধরে বেদের বিভিন্ন অংশ ও তার আপেক্ষিক গুরুত্বের কথা শুনছি। এই ধারণাটি একটু স্পষ্ট করা দরকার। আমরা আগেই জেনেছি যে প্রত্যেক বেদকে সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদ্‌–এই চার ভাগে ভাগ করা হয়েছে। কিন্তু বেদের বিষয়বস্তু অনুসারে বেদের আরেক ধরনের শ্রেণিবিভাগ প্রচলিত আছে। এই বিভাগ অনুসারে বেদকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়। এগুলি হল–(১) কর্মকাণ্ড, (২) উপাসনাকাণ্ড ও (৩) জ্ঞানকাণ্ড। প্রথমটির আলোচ্য বিষয় হল যজ্ঞানুষ্ঠানপদ্ধতি, দ্বিতীয়টির উপাসনা এবং তৃতীয়টির আলোচ্য সর্বোচ্চ জ্ঞান। বেদে যেসব অনুষ্ঠান-পদ্ধতির উল্লেখ আছে, তাই হল কর্মকাণ্ড। অন্যদিকে, ঈশ্বর কোথায় ও কিভাবে আছেন, মানুষ ও জগতের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক, তাঁকে জানার উপায় ও জানার প্রয়োজনীয়তা ইত্যাদি বিষয় আলোচিত হয়েছে যে অংশে, তার নাম জ্ঞাঙ্কাণ্ড। উপনিষদ্‌ই হল বেদের জ্ঞানকাণ্ড। মীমাংসার মতে, বেদের যজ্ঞানুষ্ঠানই প্রধান, অন্যগুলি তার প্রত্যঙ্গমাত্র। বেদান্তদর্শন এই ধারণাকে বর্জন করে। বেদান্তের মতে জ্ঞানকাণ্ডই প্রধান, অন্যদুটি জ্ঞানকাণ্ডের অনুষঙ্গ। প্রমাণের আপেক্ষিক গুরুত্ব ও বেদের শিক্ষাকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য বেদান্ত দর্শনকেই সকল দর্শনের শ্রেষ্ঠ দর্শনের মর্যাদা দেওয়া হয়।





উপসংহার


সোমনাথ মন্দির। বিগত এক হাজার বারংবার বিধর্মীদের হাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েও, পুনরায় ফিনিক্স পাখির মতো জেগে উঠা এই মন্দির হিন্দুধর্মের অবিনশ্বরতার প্রতীক।

হিন্দুধর্মের প্রধান উৎস হল বেদ। বেদ শুধুমাত্র হিন্দুধর্মেরই উৎস নয়, বরং সমগ্র ভারতীয় সংস্কৃতির উৎসমুখ। বেদে উল্লিখিত কর্ম-মীমাংসা থেকেই যাগযজ্ঞ ও অনুষ্ঠানগুলির উৎপত্তি ; উপাসনা-কাণ্ড থেকে ভক্তিবাদের উদ্ভব ; এবং দার্শনিক অংশ থেকে বেদান্তের জন্ম। বেদের অধিবিদ্যা-সংক্রান্ত তত্ত্ব থেকে ন্যায় দর্শনের জন্ম। আবার বেদের সৃষ্টিতত্ত্ব থেকে সাংখ্য দর্শনের উদ্ভব। বেদে যে ঐশ্বরিক পরমানন্দের বিবরণ আছে, তা জন্ম দিয়েছে যোগ দর্শনের। বেদের উল্লিখিত ‘ঋত’ নামে বিশেষ সৃষ্টিতত্ত্ব থেকে ‘কর্ম’ নামক নৈতিক বিধানের উৎপত্তি। বেদে উল্লিখিত ঋষি ও রাজাদের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ ধরা আছে ইতিহাস ও পুরাণে। এমনকি আমরা এও বলতে পারি, যজ্ঞের অত্যধিক বাহুল্যের বিরুদ্ধে বেদের স্থানে স্থানে যে প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছে, তারই পরিপূর্ণ রূপ হল জৈন ও বৌদ্ধধর্ম। ঠিক একইভাবে স্মৃতি, ইতিহাস, পুরাণ, আগম, দর্শন ইত্যাদি দ্বিতীয় পর্যায়ের শাস্ত্রগুলিও বেদেরই বিভিন্ন অংশকে ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে। অধ্যাপক ডি. এস. শর্মা লিখেছেন যে, বেদ হল সোনার খনি আর অন্যান্য ধর্মগ্রন্থগুলি সেই খনি থেকে উত্তোলিত সোনায় তৈরি বিভিন্ন যুগের স্বর্ণমুদ্রা। বেদের সঙ্গে অন্যান্য ধর্মগ্রন্থের সম্পর্ক এই উক্তিটির দ্বারাই বোঝা যায়। জিনিস কিনতে হলে আমাকে মুদ্রার সাহায্য নিতে হয়, নিছক ধাতুখণ্ড দিয়ে জিনিস কেনা যায় না। আবার সোনার খনিটা না থাকলে মুদ্রা তৈরির সোনাও পাওয়া যায় না। সোনার টুকরো থেকে স্বর্ণমুদ্রা বানাতে গেলে স্বর্ণকারের যন্ত্রে তাকে গড়েপিটে নিতে হয়। তেমনি বেদের সোনার সত্য যুগের প্রজ্ঞার মাধ্যমে গড়েপিটে নিয়ে আমাদের পরবর্তীকালের শাস্ত্রগুলির উদ্ভব ঘটেছে।


আধুনিক অ্যানিমেশন চলচ্চিত্রে হিন্দুধর্ম।

কেউ বলবে, এতগুলি বিধানগ্রন্থ, শাখাসম্প্রদায়ের এত ধর্মগ্রন্থ, এতগুলি দর্শনশাখা নিয়ে হিন্দুধর্মের একরূপতা কিভাবে বজায় রাখা সম্ভব? ভারত বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের দেশ ; আর এই বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের আদর্শ ভারতকে কে শিখিয়েছে? সে তো হিন্দুধর্মই। হিন্দুধর্ম তো একটা সাধারণ একরূপীয় ধর্ম নয়, হিন্দুধর্ম হল ধর্মসংঘ। এটা অনেকটা আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞান ধারণার যুক্তরাষ্ট্রের মতো। যুক্তরাষ্ট্রে যেমন একটি রাজধানীর অধীনে অনেকগুলি আপাত-স্বাধীন অঙ্গরাজ্য থাকে ; হিন্দুধর্মেও তেমনি বেদ-রাজধানীকে কেন্দ্র করে নানা সম্প্রদায় আর শাস্ত্ররূপ আপাত-স্বাধীন অঙ্গরাজ্য রয়েছে। সৌরজগতের প্রতিটি গ্রহ যেমন সূর্যকে কেন্দ্র করে প্রদক্ষিণ করে, হিন্দুদের প্রত্যেকটি ধর্মগ্রন্থই তেমনি বেদকে মধ্যমণি করে নিজের মত প্রচার করে। এই সব মতের কোনোটি উৎকৃষ্ট, কোনোটি নিকৃষ্ট। কিন্তু হিন্দুধর্মের উদার ছত্রতলে এরা সবাই আশ্রয় পায়। আর এখানেই হিন্দুধর্মের বৈশিষ্ট্য। বিশ্বের অনেক একরূপীয় ধর্ম নিজেদের মধ্যে দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে। জাতি-ভাষা-রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে বিরোধ বাধিয়েছে। কিন্তু হিন্দুধর্ম নানা ধর্মকে এক ঘরে ঠাঁই দিয়েও ঘরের শান্তি বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। দুই বাসনে ঠোকাঠুকি লাগেনি, একথা বলা যায় না ; তবে সেটা ব্যতিক্রম হিসেবেই ইতিহাসে স্থান পেয়েছে। মনে রাখা দরকার, ব্যতিক্রমই নিয়মকে চেনায়।


হিন্দুদের সকল ধর্মগ্রন্থের লক্ষ্য একই ঈশ্বর ; সেই ঈশ্বরের পবিত্রতম প্রতীক ওঁ-কার।

কেউ বলবেন, এ আবার কেমন ব্যবস্থা? উৎকৃষ্ট-নিকৃষ্ট সব মতামতকেই গ্রহণ করলে ধর্মে আর রইল কী? মুড়ি-মিছরির এক দর হয়ে গেল। তাঁদের উত্তরে বলতে হয়, ধর্মমত কী মুড়ি-মিছরি? ধর্ম হল ঈশ্বরের পৌঁছবার পথের সন্ধান। অন্য ধর্মের অনুষ্ঠান ও উপাসনা-পদ্ধতির সঙ্গে হিন্দুধর্মের অনুষ্ঠান ও উপাসনা-পদ্ধতির তুলনা করে হিন্দুধর্মের নিন্দা করাটা হাস্যকর। ধর্ম কী শুধুই অনুষ্ঠান আর উপাসনা-পদ্ধতি? হিন্দুধর্মের উদারতা এখানেই যে, এই ধর্ম ঈশ্বরের কাছে পৌঁছবার সকল পথকেই স্বীকৃতি দেয়। আর সেই সকল পথকে ঈশ্বরের পথেরই মর্যাদা দেয়, তাকে নিছক অনুষ্ঠান ও উপাসনা-পদ্ধতি বলে তার অবমাননা করে না। সকল ধর্মই মানুষকে ঈশ্বরের পথে নিয়ে যায়। শ্রীরামকৃষ্ণ যেমন বলেছেন, ‘যত মত তত পথ’। ধর্মগুলি যে রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার তার পিছনে প্রধানত ঈশ্বরোলব্ধির মহৎ আদর্শটিই কাজ করে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই সব প্রতিষ্ঠান আদর্শচ্যূত হয় এবং তা ধর্মকে ঈশ্বরের পথ থেকে সরিয়ে এনে বিপথগামী করে ও সকলের ত্রাসে পরিণত হয়। সে অন্য প্রসঙ্গ। ধর্ম যদি সঠিকভাবে ঈশ্বরের পথে চলে, তাহলে মানুষ শেষ পর্যন্ত ঈশ্বরের কাছেই উপনীত হয়। আমরা হিন্দুরা মানুষের এই অবস্থাকেই ‘মোক্ষ’ বা সর্বোচ্চ মুক্তি নামে উল্লেখ করে থাকি। মোক্ষই হিন্দুধর্মের চূড়ান্ত লক্ষ্য। হিন্দুধর্মের সকল শাস্ত্র ও সব উপাসনার সর্বশেষ গন্তব্য।

কৃতজ্ঞতা স্বীকার–

ইংরেজি বই

১। আ প্রাইমার অফ হিন্দুইজম ; ডি. এস. শর্মা ; শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ, চেন্নাই

২। দ্য প্রস্থানত্রয়: অ্যান ইন্ট্রোডাকশন ; স্বামী হর্ষানন্দ ; রামকৃষ্ণ মঠ, বেঙ্গালুরু

৩। হিন্দু স্ক্রিপচারস: আ ব্রিফ অ্যানথোলজি ; স্বামী হর্ষানন্দ ; রামকৃষ্ণ মঠ, বেঙ্গালুরু

৪। দ্য সিক্স সিস্টেমস অফ হিন্দু ফিলোজফি: আ প্রাইমার ; স্বামী হর্ষানন্দ ; শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ, চেন্নাই

বাংলা বই

১। হিন্দুধর্ম ; স্বামী নির্মলানন্দ ; রামকৃষ্ণ মিশন কলিকাতা বিদ্যার্থী আশ্রম, কলকাতা

২। প্রশ্নোত্তরে হিন্দুধর্ম ; স্বামী হর্ষানন্দ ; উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা

৩। সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাস ; ধীরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ; পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষৎ, কলকাতা

রচনাস্বত্ব–

© অর্ণব দত্ত

বিবেকানন্দ বেদান্ত কেন্দ্র, বড়িশা, কলকাতা

২০১২

© Arnab Dutta

Vivekananda Vedanta Centre, Barisha, Kolkata

Pages