হিন্দু ধর্মের যে এক ও অদ্বিতীয় সত্তা, তার নাম হলো ব্রহ্ম। ঈশ উপনিষদের ব্রহ্মের প্রকৃতি হিসাবে বলা হয়েছে-
ওঁ পূর্ণমদঃ পূর্ণমিদং পূর্ণাত্ পূর্ণমুদচ্যতে।
পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে
সরলার্থ : উহা (পরব্রহ্ম) পূর্ণ, ইহা (নামরূপে স্থিত ব্রহ্ম) পূর্ণ; এই সকল সূক্ষ্ম ও স্থূল পদার্থ পরিপূর্ণ ব্রহ্ম হইতে উদগত বা অভিব্যক্ত হইয়াছে। আর সেই পূর্ণস্বভাব ব্রহ্ম হইতে পূর্ণত্ব গ্রহণ করিলেও পূর্ণই অর্থাৎ পরব্রহ্মই অবশিষ্ট থাকেন। ত্রিবিধ বিঘ্নের (আধ্যাত্মিক, আধিদৈবিক ও আধিভৌতিক) শান্তি হোক। ঈশ উপনিষদ। শান্তিপাঠ। [অতুলচন্দ্র সেন, সীতানাথ তত্ত্বভূষণ, মহেশচন্দ্র কর্তৃক অনূদিত ও সম্পাদিত- উপনিষদের অখণ্ড সংস্করণ থেকে উদ্ধৃত করা হলো।]
উপনিষদে বর্ণিত ব্রহ্ম অদ্বিতীয় সত্তা। ইনি সূক্ষ্ম ও স্থূল সকল কিছূরই উত্স। এই উত্স থেকে জগতের বিভিন্ন উপকরণের সৃষ্টি হয়। এর সমর্থন পাওয়া যায় অন্যান্য হিন্দু ধর্মগ্রন্থে। যেমন- মার্কেণ্ডয় পুরাণে আছে-
যা অব্যক্ত এবং ঋষিরা যাকে প্রকৃতি বলে থাকেন, যা ক্ষয় বা জীর্ণ হয় না, রূপ রস গন্ধ শব্দ ও স্পর্শহীন, যার আদি অন্ত নেই, যেখান থেকে জগতের উদ্ভব হয়েছে, যা চিরকাল আছে এবং যার বিনাশ নেই, যার স্বরূপ জানা যায় না, সেই ব্রহ্ম সবার আগে বিরাজমান থাকেন। মার্কেণ্ডয় পুরাণ/শ্রীসুবোধকুমার চক্রবর্তৗ।
উপনিষদ ও মার্কেণ্ডয় পুরাণ অনুসারে- দেখা যাচ্ছে, সৃষ্টির আদিতে পরমব্রহ্ম বিরাজ করেন। এবং সেই পরমব্রহ্ম থেকেই জগতের সব কিছু সৃষ্টি হয়। এই সৃষ্টি প্রক্রিয়ার স্তরগুলো সম্পর্কে মার্কেণ্ডয় পুরাণে যা বিবৃত হয়েছে, তা হলো-
সত্ত্ব (প্রকৃতি) রজ (যার প্রভাবে অহংকারসহ অন্যান্য মন্দগুণের জন্ম হয়) ও তম (অন্ধকার) এই তিন গুণ তাঁর মধ্যে পরস্পরের অনুকূলে ও অব্যাঘাতে অধিষ্ঠিত আছে। সৃষ্টির সময়ে তিনি (ব্রহ্ম) এই গুণের সাহায্যে সৃষ্টিক্রিয়ায় প্রবৃত্ত হলে প্রধান তত্ত্ব প্রাদুর্ভূত হয়ে মহত্তত্ত্বকে (মহৎ নামক তত্ত্ব) আবৃত করে। এই মহত্তত্ত্ব তিনগুণের ভেদে তিন প্রকার। এর থেকে তিন প্রকার ত্রিবিধ অহঙ্কার প্রাদুর্ভূত হয়। এই অহঙ্কারও মহত্তত্ত্বে আবৃত ও তার প্রভাবে বিকৃত হয়ে শব্দতন্মাত্রের সৃষ্টি করে। তা থেকেই শব্দ লক্ষণ আকাশের জন্ম। অহঙ্কার শব্দমাত্র আকাশকে আবৃত করে এবং তাতেই স্পর্শতন্মাত্রের জন্ম। এতে বলবান বায়ু প্রাদুর্ভূত হয়। স্পর্শই বায়ুর গুণ। শব্দমাত্র আকাশ যখন স্পর্শমাত্রকে আবৃত করে, তখন বায়ু বিকৃত হয়ে রূপমাত্রের সৃষ্টি করে। বায়ু থেকে জ্যোতির উদ্ভব, রূপ ঐ জ্যোতির গুণ। স্পর্শমাত্র বায়ু যখন রূপমাত্রকে আবৃত করে, তখন জ্যোতি বিকৃত হয়ে রসমাত্রের সৃষ্টি করে। তাতেই রসাত্মক জলের উদ্ভব। সেই রসাত্মক জল যখন রূপমাত্রকে আবৃত করে তখন জল বিকৃত হয়ে গন্ধমাত্রের সৃষ্টি করে। তাতেই পৃথিবীর জন্ম হয়। মার্কেণ্ডয় পুরাণ/শ্রীসুবোধকুমার চক্রবর্তৗ।
পুরাণের এই বিবৃত থেকে বুঝা যায় ব্রহ্মা প্রকৃতিকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় রূপান্তর করে পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন।
মহাভারতের আদিপর্বের সৃষ্টিবর্ণন অংশের- সৃষ্টি তত্ত্ব থেকে যে ধারণা পাই তা কিছুটা আধুনিক বিজ্ঞানের সমার্থক বলেই বোধ হয়। আধুনিক বিজ্ঞান বলে- আদিতে বস্তুপুঞ্জ একত্রিত হয়ে একটি পিণ্ডের সৃষ্টি হয়েছিল। উক্ত পিণ্ডের বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে বর্তমান মহাবিশ্বের জন্ম হয়েছিল। তবে মহাভারতে এর সাথে ঐশ্বরিক সত্তার মহিমা যুক্ত করার কারণে- এই বর্ণনা ভিন্ন মাত্রায় রূপ পরিগ্রহ করেছে। যেমন-
প্রথমতঃ এই বিশ্বসংসার কেবল ঘোরতর অন্ধকারে আবৃত ছিল। অনন্তর সমস্ত বস্তুর বীজভূত এক অণ্ড প্রসূত হইল। ঐ অণ্ডে অনাদি, অনন্ত, অচিন্তনীয়, অনির্বচনীয়, সত্যস্বরূপ নিরাকার, নির্বিকার, জ্যোতির্ময় ব্রহ্ম প্রবিষ্ট হইলেন। অনন্তর ঐ অণ্ডে ভগবান্ প্রজাপতি ব্রহ্মা স্বয়ং জন্ম পরিগ্রহ করিলেন। তত্পরে স্থাণু, স্বায়ম্ভু মনু দশ প্রচেতা, দক্ষ, দক্ষের সপ্ত পুত্র, সপ্তর্ষি, চতুর্দশ মনু জন্মলাভ করিলেন। মহর্ষিগণ একতানমনে যাঁর গুণকীর্তন করিয়া থাকেন, সেই অপ্রমেয় পুরুষ, দশ বিশ্বদেব, দ্বাদশ আদিত্য, অষ্টবসু, যমজ অশ্বিনীকুমার, যক্ষ, সাধুগণ, পিশাচ, গুহ্যক এবং পিতৃগণ উত্পন্ন হইলেন। তত্পরে জল, পৃথিবী, বায়ু, আকাশ, দশ দিক্, সংবত্সর, ঋতু, মাস, পক্ষ, রাত্রি ও অন্যান্য বস্ত ক্রমশঃ সঞ্চাত হইল। (কালীপ্রসন্নসিংহ কর্তৃক অনূদিত সংস্করণ থেকে।)
হিন্দু ধর্মগ্রন্থগুলোতে সৃষ্টি-তত্ত্বের রূপ মোটামুটি এই ভাবেই বিবৃত হয়েছে। এই সকল বর্ণনা অনুসারে যে সার কথা পাওয়া যায় তা হলো- আদিতে ব্রহ্ম নামক পরম সত্তা ছিল। উক্ত সত্তা প্রকৃতিকে একটি বিশাল অণ্ডে রূপান্তরিত করলেন। উক্ত অণ্ড থেকে সৃষ্টি হয়েছিল বিশ্ব-চরাচর এবং দেবতাসহ অন্যান্য সকল প্রাণী।
সুত্র ধরে---
আদিকাল থেকে এখনো পর্যন্ত এ যেন মানুষের এক অনন্ত জিজ্ঞাসা।
সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে বেদ এর বিখ্যাত নাসাদিয় সুক্ত এবং হিরন্যগর্ভ সুক্ত এর কথা অনেকেই জানেন।ধর্মবিশেষজ্ঞ ও বিজ্ঞানী মহলে বহুল আলোচিত এই দুটি সুক্তের আলোকে সৃষ্টিতত্ত্ব সংক্ষেপে আলোচনা করা হল-
ঋগবেদ ১০/১২৯/১
"নাসাদাসিস নঃ সদাসিত্ তদানীম নাসিদ রজ ন ব্যামাপ্রো যৎ..."
"শুরুতে কোন অস্তিত্ব(সৎ) বা অনস্তিত্ব(অসৎ) ছিলনা।সেখানে ছিলনা কোন বায়ুমন্ডল"
ঋগবেদ ১০/১২৯/৩
"তম অসিৎ তমস... তপসস্তন্মহিনাজায়াতৈকম”
"চারদিক ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন। সমস্ত জিনিস একত্রে পুন্জীভুত ছিল।সেখান থেকে প্রচন্ড তাপের সৃষ্টি হল"
একইভাবে
ঋগবেদ ১০/১২১/১
"হিরন্যগর্ভ সামাভরতাগ্রে.."
"প্রথমেই হিরন্যগর্ভ সৃষ্টি হল"
ঋগবেদ ১০/১২১/৭
"আপ হ য়দ বৃহাতিরিবিশ্বমা য়ান গর্ভম..."
"সেই হিরন্যগের্ভ ছিল উত্তপ্ত তরল যাতে ছিল সৃষ্টির সমস্ত বীজ"
একই ধরনের কথা বলছে শতপথ ব্রাক্ষ্মন ১১.১.৬.১
"হিরন্যগর্ভানি অপঃ তে সলিলা..."
"প্রথমে হিরন্যগর্ভ সৃষ্টিহল।সেখানে ছিল উত্তপ্ত গলিত তরল।এটি ছিল মহাশুন্যে ভাসমান।বছরের পরবছর এই অবস্থায় অতিক্রান্ত হয়।"
ঋগবেদ ১০.৭২.২
"তারপর যেখানে বিস্ফোরন ঘটল গলিত পদার্থ থেকে,বিন্দু থেকে যেন সব প্রসারিত হতে শুরু হল"
ঋগবেদ ১০.৭২.৩
"সেই বিস্ফোরিত অংশসমূহ থেকে বিভিন্ন গ্রহ,নক্ষত্র তৈরী হল"
ঋগবেদ ১০.৭২.৪
"তার এক জীবনপ্রদ অংশ থেকে পৃথিবী সৃষ্টি হল"
ঋগবেদ ১০.৭২.৮-৯
"তারপর সৃষ্ট ক্ষেত্রে সাতধাপে সংকোচন-প্রসারন সম্পন্ন হল।তারপর সৃষ্টি হল ভারসাম্যের।"
এই অংশটুকু পরলেই স্পষ্ট বোঝা যায় বেদের সৃষ্টিতত্ত আধুনিক বিজ্ঞানের সাথে কতটুকু সামঞ্জস্যপূর্ণ।সৃষ্টিতত্তের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মডেল “Lambda-CDM Concordance Model” অনুযায়ী “the evolution of the universe from a very uniform, hot, dense primordial state to its present অর্থাৎ একটি উত্তপ্ত, কেন্দ্রীভূত আদি অবস্থা থেকেই বর্তমান অবস্থার উত্থান।”এছাড়া বেদ এ উল্লেখিত বিস্ফোরণ বর্তমান বিশ্বের বহুল আলোচিত বিগ ব্যাংগ তত্তের সাথে প্রায় পুরোপুরি মিলে যায়।
আশ্চর্যের এখানেই শেষ নয়।বেদ এর মতে সৃষ্টির শুরুতেই ওঁম উচ্চারিত হয় আর এর প্রভাবেই হয় বিস্ফোরন ।
বেদান্ত সূত্র(4/22)
"অনাবৃতিঃ শব্দহম"
অর্থাৎ শব্দের মাধ্যমেই সৃষ্টির শুরু যা মাত্র দুই বছর আগে বিজ্ঞানীরা আবিস্কার করেছেন।
বিজ্ঞানীদের দেয়া নতুন STRING THEORY অনুযায়ী প্রথমেই একটা অতি নিম্ন তড়ঙ্গ দৈর্ঘ্য এর শব্দ তড়ঙ্গ তৈরী হয় যার ধাক্কায় বিস্ফোরণ শুরু হয়!
তাই বেদের সৃষ্টিতত্ত পড়ে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় এর Dr. Kevin Hurley বলেছিলেন
"How could Aryan sages have known all this 6000 years ago, when scientists have only recently discovered this using advanced equipments which didn't exist that time!"
তথ্যসূত্র VEDA, The infallible word of GOD
বিজ্ঞান আর ধর্ম ‘ – এই দুই উপাদান মিলিয়েই আমাদের বিশ্বাস। কিন্তু প্রায়ই নান বিষয়ে ধর্ম আর বিজ্ঞানের মধ্যে লেগে যায় ঠোকাঠুকি। বিজ্ঞান বিশ্বাস করতে গেলে ধর্ম থাকে না, আবার ধর্মীয় মতবাদ মানতে চাইলে হতে হয় পশ্চাদগামী।
মহাবিশ্বে সৃষ্টি নিয়ে বৈজ্ঞানিক মতবাদ ’বিগ ব্যাং’, এটা মানতে চাইলে বাদ সাঁধে ধর্মীয় মতবাদ। এক্ষেত্রে বিজ্ঞান বলে এককথা আর আর বিভিন্ন ধর্মে আছে নানা কথা।
মহাবিশ্বের সৃষ্টি রহস্য নিয়ে বৈজ্ঞানিক মতবাদ আর ধমীয় মতবাদগুলোর প্রতি চোখ রাখা যাক –
বিগব্যাং
মহাবিশ্ব সৃষ্টির আধুনিক বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব হলো বিগ ব্যাং । এই তত্ত্ব অনুসারে ১৫০০ কোটি বৎসর আগের কোন এক সময় একটি বিশাল বস্তুপিণ্ডের বিস্ফোরণের ফলে মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছিল। ১৯২৭ সালে বেলজিয়ামের বিজ্ঞানী জর্জ লেমিটর (Georges Lemaitre) এই তত্ত্ব প্রথম প্রকাশ করেন। তাঁর মতে সৃষ্টির আদিতে মহাবিশ্বের সকল বস্তু আন্তঃআকর্ষণে পুঞ্জীভূত হয় এবং একটি বৃহৎ পরমাণুতে পরিণত হয়। এই পরমাণুটি পরে বিস্ফোরিত হয়ে মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়। এই মতবাদকে সমর্থন ও ব্যাখ্যা করেন এডুইন হাবল (Edwin Hubble)। হাবল পর্যবেক্ষণ দ্বারা প্রমাণ পান যে— মহাকাশের গ্যালাক্সিগুলো পরস্পর থেকে ক্রমান্বয়ে নির্দিষ্ট গতিতে দূরে সরে যাচ্ছে। তাঁর মতে, আদিতে মহাবিস্ফোরণের ফলে গ্যালাক্সিগুলো সৃষ্টি হয়েছিল এবং এগুলোর দূরে সরে যাওয়ার আচরণ বিগ-ব্যাংকেই সমর্থন করে।
এই ভাবে বিস্ফোরণের ফলে যে বিকিরণের (radiation) সৃষ্টি হওয়ার কথা, তার অস্তিত্ব প্রথম দিকে প্রমাণ করা যায় নি। ফলে বিষয়টি নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব উপস্থিত হয়। ১৯৬৪ সালে Arno Penzias এবং Robert Wilson নামক দুজন বিজ্ঞানী বিকিরণের অস্তিত্ব প্রমাণ করেন। ফলে বিগব্যাং-এর ধারণা আরও সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। মহাবিশ্ব সৃষ্টির ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত এই তত্ত্বকেই সত্য বলে বিবেচনা করা হয়।
বিগব্যাং মতবাদ অনুসারে মহাবিশ্ব সৃষ্টি রহস্য
আদিতে মহাকাশের বস্তুপুঞ্জ বিক্ষিপ্তাকারে ছড়ানো ছিল। অবশ্য এই আদি বস্তুপুঞ্জ কিভাবে সৃষ্টি হয়েছিল এবং এগুলোর বিন্যাস কিরূপ ছিল, তার ব্যাখ্যা বিজ্ঞানীরা দিতে পারেন নি। বিগব্যাং তত্ত্ব অনুসারে— প্রায় ১৫০০ কোটি বৎসর আগে এই সকল বিক্ষিপ্ত বস্তুগুলো আন্ত-আকর্ষণের কারণে পরস্পরের কাছে আসতে থাকে এবং ধীরে ধীরে একটি ডিমের আকার ধারণ করে। বিজ্ঞানীরা একে নামকরণ করেছেন মহাপরমাণু (Supper Atom)। উল্লেখ্য এই সময় কোন স্থান ও কালের অস্তিত্ব ছিল না। অসীম ঘনত্বের এই মহাপরমাণুর ভিতরে বস্তুপুঞ্জের ঘন সন্নিবেশের ফলে এর তাপমাত্রা দাঁড়িয়েছিল- যে কোন পরিমাপ স্কেলের বিচারে ১০১৮ ডিগ্রী। বিগ ব্যাং-এর পরের ১ সেকেন্ডে যে ঘটনাগুলি ঘটেছিল, তা কালানুক্রমে নিচে তুলে ধরা হলো-
১ থেকে ১০-৪৩ সেকেণ্ড : কোয়ান্টাম সূত্রানুসারে বিগব্যাং-এর ১০-৪৩ সেকেন্ডের [এই সময়কে প্লাঙ্ক-অন্তঃযুগ (Planck epoch) বলা হয়] ভিতর চারটি প্রাকৃতিক বলের (force) সমন্বয় ঘটেছিল। এই বলগুলো হলো- সবল নিউক্লীয় বল, দুর্বল নিউক্লীয় বল, বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বল ও মহাকর্ষীয় বল। সবগুলো মিলে একটি অতি বৃহৎ বলের (super force) সৃষ্টি হয়েছিল।
প্লাঙ্ক-অন্তঃযুগ থেকে ১০-৩৫ সেকেণ্ড : প্লাঙ্কের সময় অতিবাহিত হওয়ার কিছু পরে মহাকর্ষীয় বল, অন্য তিনটি বল থেকে পৃথক হয়ে গিয়েছিল। ফলে মাধ্যাকর্ষণজনিত শক্তির কারণে, মহাপিণ্ডটি সর্বোচ্চ সংকোচন মাত্রায় পৌঁছেছিল। তখন ঘনত্বের বিচারে মহাপরমাণুর প্রতি ঘন সেন্টিমিটারে বস্তু ছিল ৫১০+৯৩ গ্রাম। এই সময় এর তাপমাত্রা ছিল ১০৩২ কেলভিন। ১০-৩৫ সেকেন্ড সময়ের মধ্যে এই তাপমাত্রা এসে দাঁড়িয়েছিল প্রায় ১০২৭ কেলভিন। এই সময় কোয়ার্ক ও লেপ্টন কণার সৃষ্টি হয়েছিল। একই সাথে তৈরি হয়েছিল— কিছু বস্তু এবং প্রতিবস্তুসমূহ (antiparticles)। পরে বস্তু ও তার প্রতিবস্তুর মধ্যে সংঘর্ষ হলে উভয় ধরনের বস্তুগুলো ধ্বংস হয়ে যায়। এর ফলে শুধু কোয়ার্ক ও লেপ্টন রয়ে যায়।
১০-৩৫ থেকে ১০-১০ সেকেণ্ড : পরবর্তী ১০-১০ সেকেন্ড সময়ের মধ্যে তাপমাত্রা নেমে আসে ১০১৬ কেলভিনে। এই তাপমাত্রা পরে আরও কমে গেলে দুর্বল নিউক্লীয় বল ও বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বল পৃথক হয়ে যায়। এই সময় কোয়ার্কসমূহ সবল বলের প্রভাবে আবদ্ধ হয়ে সৃষ্টি করে ফোটন, প্রোটন এবং নিউট্রন।
১ সেকেন্ড পরে : ১ সেকেন্ড পরে তাপমাত্রা নেমে আসে ১০১০ কেলভিনে। কিন্তু এই তাপমাত্রায় পরমাণু সৃষ্টি অসম্ভব ছিল।
ধারণা করা হয় বিগব্যাং-এর ৩ সেকেণ্ড থেকে ১০০,০০০ বৎসরের মধ্যে সৃষ্ট কণাগুলো শীতল হয়ে উঠে। এই অবস্থায় বস্তুপুঞ্জে বিরাজমান ইলেক্ট্রন, প্রোটন ও নিউট্রন মিলিত হয়ে তৈরি হয় হাইড্রোজন ও হিলিয়াম পরমাণু। এ ছাড়া এই দুটি পদার্থের সাথে ছিল প্রচুর ইলেক্ট্রন প্লাজমা। সব মিলিয়ে যে বিপুল বস্তুকণার সমাবেশ ঘটেছিল, সেগুলো প্রচণ্ড গতিতে বিগ ব্যাং-এর কেন্দ্র থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল। এই সময় এই সকল কণিকাও ছিল অত্যন্ত উত্তপ্ত। ক্রমে ক্রমে এগুলো শীতল হতে থাকলো এবং এদের ভিতরের আন্তঃআকর্ষণের কারণে- কাছাকাছি চলে এসেছিল। ফলে বিপুল পরিমাণ বস্তুপুঞ্জ পৃথক পৃথক দল গঠন করতে সক্ষম হয়েছিল। এই পৃথক দল গঠনের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পত্তন ঘটেছিল গ্যালাক্সি’র (Galaxy)। আমাদের সৌরজগতও এরূপ একটি গ্যালাক্সির ভিতরে অবস্থান করছে। এই গ্যালাক্সির নাম ছায়াপথ (Milky Way)।
এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড কে সৃষ্টি করেছেন? কেনই বা জগৎসৃষ্টি করেছেন? এসব প্রশ্ন সবার মনেই জাগ্রত হয়। জগৎস্রষ্টার সৃষ্টিরহস্য ভেদ করা মনুষের পক্ষে দুঃসাধ্য। তত্ত্বদ্রষ্টা ঋষিরা ধ্যানযোগে সৃষ্টিতত্ত্ব সম্পর্কে যা জানতে পেরেছেন তা শিষ্যদের নিকট ব্যক্ত করে গেছেন। শুরুতেই বৈদিক ঋষি কর্তৃক বর্ণিত সৃষ্টিতত্ত্ব প্রসঙ্গে আসা যাক।
সৃষ্টিতত্ত্ব
বেদে সৃষ্টিতত্ত্ব
ঋক্-বেদের ১০ম মণ্ডলের ৮২ নং সূক্তে আছে- ‘‘যিনি এসব সৃষ্টি করছেন তাকে তোমরা বুঝতে পার না। তোমাদের অন্তঃকরণ তা বোঝায় ক্ষমতা প্রাপ্ত হয়নি। কুজ্বটিকাতে আচ্ছন্ন হয়ে লোকে নানা প্রকার জল্পনা করে’’। ঋকবেদের ‘‘নাসদীয় সূক্তে’’ সৃষ্টিতত্ত্ব সম্পর্কে যে আলোচনা করা হয়েছে তা এরকম-‘‘সেকালে যা নেই তা ছিলনা, যা আছে তাও ছিলনা। পৃথবীও ছিল না, অতি দূরবিস্তার আকাশও ছিল না। আবরণ করে এমন কিছু ছিল না। কোথায় কার স্থান ছিল? দুগর্ম ও গম্ভীর জল কি তখন ছিল? তখন মৃত্যু ছিল না, অমরত্বও ছিল না। রাত্রি ও দিনের প্রভেদ ছিল না। কেবল সে একমাত্র বস্ত্ত বায়ুর সাহায্য ব্যতিরেকে আত্মা মাত্র অবলম্বনে নিশ্বাস-প্রশ্বাসযুক্ত হয়ে জীবিত ছিলেন। তিনি ব্যতীত আর কিছুই ছিল না। সর্বপ্রথমে অন্ধকারের দ্বারা অন্ধকার আবৃত ছিল। সমসত্মই চিহ্ন বর্জিত ও চতুর্দিক জলময় ছিল। অবিদ্যমান বস্তু দ্বারা সে সর্বব্যাপী আচ্ছন্ন ছিলেন। তপস্যার প্রভাবে সে এক বস্ত্ত জন্ম নিল। সর্বপ্রথমে মনের উপর কামের আবির্ভাব হল। তা হতে সর্বপ্রথম উৎপত্তির কারণ নির্গত হল। বুদ্ধিমানগণ বুদ্ধি দ্বারা আপন হৃদয়ে পর্যালোচনাপূর্বক অবিদ্যমান বস্ত্ততে বিদ্যমান বস্ত্ত উৎপত্তিস্থান নিরূপণ করলেন। রেতোধা পুরুষেরা উদ্ভব হলেন, মহিমা (পঞ্চভূত) সকল উদ্ভব হল। ওদের রশ্মি দু-পার্শ্বে ও নিম্নের দিকে এবং ঊর্ধদিকে বিস্তারিত হল, নিম্নদিকে স্বধা (নিকৃষ্ট অন্ন) থাকল, প্রযতি (ভোক্তা পুরুষ) ঊর্ধদিকে থাকলেন। কেই বা প্রকৃত জানে? কেই বা বর্ণনা করবে। কোথা হতে জন্মগ্রহণ করলে? কোথা হতে এসব নানা সৃষ্টি হল? দেবতারা এ সমস্ত নানাবিধ সৃষ্টির পর হয়েছেন, কোথা হতে যে হল তা কেই বা জানেন? এ নানাবিধ সৃষ্টি কোথা হতে হল? কার থেকে হল? কেউ সৃষ্টি করেছেন, কি করেননি, তা তিনিই জানেন। যিনি এর প্রভূ স্বরূপ পরমধামে আছেন অথবা তিনিও না জানতে পারেন।
ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলে পুরুষ সূক্তে আছে- ‘‘সহস্র মস্তক, চক্ষু ও চরণবিশিষ্ট এক পুরুষ। তিনি অমর। তার তিন পাদ আকাশে (অমর অংশ) এবং এক পাদ ব্যক্ত হয়ে বিশ্বজগৎ হয়েছে’’। ঋগ্বেদের ১০ম মণ্ডলের ৮২ নং সূক্তে আছে, ‘‘বিশ্বকর্মা এই বিশ্ব সৃষ্টি করেছেন। এই বিশ্বভূবন প্রথমে জলাকৃতি ছিল। পরে তিনি এ জলাকৃতিকে বিশ্বভূবনে পরিণত করলেন। যখন চতুঃসীমা ক্রমশ দূর হয়ে উঠল, তখন দ্যুলোক (স্বর্গ) ও ভূলোক (পৃথিবী) পৃথক হয়ে গেল।
উপনিষদে সৃষ্টিতত্ত্ব
ঐতয়ের উপনিষদে আছে, সৃষ্টির পূর্বে এই দৃশ্যমান জগৎ একমাত্র অদ্বিতীয় আত্মা স্বরূপেই বর্তমান ছিল। নিমেষাদি ক্রিয়াযুক্ত অপর কিছুই ছিল না। সেই আত্মা চিন্তা করলেন-আমি লোকসমূহ সৃষ্টি করব। তারপর তিনি ক্রমে ক্রমে অম্ভলোক (দ্যুলোকের উপরে অবস্থিত জললোক ধারণ করে) মরীচিলোক (আকাশ), মরলোক (পৃথিবী) ও অপলোক (নদী ও সমুদ্র) সৃষ্টি করলেন। তারপর তিনি লোকপাল সৃষ্টি করার চিন্তা করলেন। তখন তিনি জল থেকে পুরুষাকার পিণ্ডকে গ্রহণ করে সেই পিণ্ডকে উদ্দেশ্য করে সঙ্কল্প করলেন। সে সঙ্কল্পের ফলে পাখীর ডিমের মত মুখবিবর ফুটিয়ে বাহির হল। সে মুখ-গহবর থেকে বাক্-ইন্দ্রিয় এবং এর অধিদেবতা অগ্নি প্রকাশ পেলেন। অতঃপর নাসিকা থেকে ঘ্রাণেন্দ্রিয় এবং ঘাণেন্দ্রিয় থেকে এর অধিদেবতা বায়ু প্রকাশিত হলেন। ঘ্রাণেন্দ্রিয় সৃষ্টির পর ক্রমে ক্রমে দর্শন-ইন্দ্রিয় ও এর অধিদেবতা সূর্য, শ্রবণেন্দ্রিয় ও এর অধিদেবতা দিকসমূহ এবং স্পর্শেন্দ্রিয় ও এর অধিদেবতা বায়ু প্রকাশিত হলেন। এর পর হৃদপদ্ম প্রকাশিত হল। হৃদপদ্ম থেকে অন্তঃকরণ (মন, বুদ্ধি, অহংকার ও চিত্ত) এবং এর দেবতা চন্দ্র প্রকাশিত হলেন। চন্দ্র প্রকাশিত হওয়ার পর নাভি প্রকশিত হল। নাভি থেকে অপান (পায়ু ইন্দ্রিয়) এবং অপান হতে এর অধিদেবতা মৃত্যু অভিব্যক্ত হলেন। তারপর শিশ্ন (জননেন্দ্রিয়) বাহির হল। শিশ্ন থেকে রেতঃ (শুক্র সমন্বিত ইন্দ্রিয়) প্রকাশ পেল এবং রেতঃ থেকে এর অধিদেবতা প্রজাপতি প্রকটিত হলেন। ঈশ্বর পিণ্ডাকৃতির পুরুষে ক্ষুধা-তৃষ্ণা প্রবেশ করালেন। তখন ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর দেবগণ ঈশ্বরের নিকট অন্ন ভোজনের জন্য আশ্রয় প্রার্থনা করলেন। দেবতাদের কথা শুনে ঈশ্বর প্রথমে গরু আকৃতির পিণ্ড তৈরি করলেন কিন্তু তাতে দেবতারা সন্তুষ্ট হলেন না। তখন ঈশ্বর অশ্ব আকৃতির পিণ্ড তৈরি করলেন কিন্তু তাতেও দেবতারা সন্তুষ্ট হলেন না। তারপর ঈশ্বর পুরুষ আকৃতির এক পিণ্ড তৈরি করলে দেবতারা সন্তুষ্ট হলেন এবং তাঁর নির্দেশে স্ব স্ব স্থান অধিকার করলেন। ঐ পুরুষের দেহে ক্ষুধা-তৃষ্ণাকেও স্থান দেয়া হল। তারপর দেবতারা ক্ষুধা-তুষ্ণা নিবারণের জন্য অন্ন সৃষ্টি করলেন। সে পুরুষ অপান বায়ু দ্বারা অন্নগ্রহণ করতে সমর্থ হলেন। পরমেশ্বর ইন্দ্রিয়গণকে পরিচালনা করার জন্য মাথার কেশ বিভক্ত স্থান (মস্তকের মধ্যদেশ) বির্দীণ করে ব্রহ্মরন্ধ্র পথেই সে পুরম্নষে প্রবেশ করলেন, সেজন্য ঐ দ্বারকে বিদৃতি দ্বার বলে। পরমেশ্বরের প্রকাশ স্থান তিনটি, যথা- জাগ্রত অবস্থায় চক্ষু, স্বপ্নাবস্থায় মন এবং সুষুপ্তি অবস্থায় হৃদয়াকাশ।
ছান্দোগ্য উপনিষদে বর্ণিত আছে, এ জগৎ পূর্বে অসৎ (নাম ও রূপহীন) ছিল। সৃষ্টির সময় তা সৎ (সত্ত্বা-বিশিষ্ট) ও ডিম্বে পরিণত হল। এক বৎসর স্পন্দনহীন অবস্থায় থেকে সে ডিম্ব বিভক্ত হল। ডিম্বের একভাগ রজতময় (রৌপ্যময়) এবং অপরভাগ স্বর্ণময় হল। রজতময় অংশ থেকে পৃথিবী, সুবর্ণময় অংশ থেকে স্বর্গ, জরায়ু থেকে পর্বত সমূহ, উল্ব (সূক্ষ্মগর্ভ-বেষ্টন) থেকে মেঘ ও তুষার, ধমনী থেকে নদীসমূহ এবং বস্তি (মুত্রাশয় প্রদেশের জল) থেকে সমুদ্র সৃষ্টি হয়েছে। তারপর সূর্য সৃষ্টি হলে ‘উলু উলু’ ধ্বনিত হল। তৈত্তিরীয় উপনিষদে উল্লেখ আছে, ব্রহ্ম হতে আকাশ, আকাশ হতে বায়ু, বায়ু হতে অগ্নি, অগ্নি হতে জল, জল হতে পৃথিবী, পৃথিবী হতে ওষধিসমূহ (যেসব উদ্ভিদ একবার ফল দিয়ে মরে যায়), ওষধিসমূহ হতে অন্ন, অন্ন হতে বীর্য (শুক্র) এবং বীর্য হতে পুরুষের সৃষ্টি হয়েছে।
স্মৃতি-শাস্ত্রে সৃষ্টিতত্ত্ব
মনুসংহিতা মতে ব্রহ্মার মানস পুত্র দশজন, যথা- মরীচি, অত্রি, অঙ্গিরা, পুলস্ত্য, পুলহ, ক্রতু, প্রচেতা, বশিষ্ট, ভৃগু ও নারদ। এই দশজন মুনি যক্ষ (কুবেরের অনুচরগণ), রক্ষ (রাক্ষস), পিশাচ, গন্ধর্ব (নৃত্য ও গীতবিদ্যায় পারদর্শী দেবগণের অনুচর), কিন্নর (স্বর্গের গায়ক), অসুর, নাগ, সর্প, বানর, মৎস্য, পক্ষী, গরু-ছাগলাদি পশু, মৃগ, সিংহ, ব্যাঘ্র, কৃমি, কীট, পতঙ্গ, যূকা (উকুন), মক্ষিকা (মাছি), মৎকুণ (ছার-পোকা), মশক প্রভৃতি জীব সৃষ্টি করলেন। দশ মুনি কর্তৃক সৃষ্ট জীবদের চার ভাগে ভাগ করা যায়, যথা- জরায়ুজ), অণ্ডজ (অণ্ড বা ডিম থেকে যাদের জন্ম, যেমন- পক্ষী, সর্প, কুমীর, মৎস্য, কচ্ছপ প্রভৃতি), স্বেদজ (স্বেদ বা ঘাম থেকে যাদের জন্ম, যেমন- মশা, উকুন, মাছি, ছার-পোকা, দংশ বা ডাঁশ প্রভৃতি) এবং উদ্ভিজ্জ (মাটি ভেদ করে যা উপরে ওঠে, যেমন- লতা, গুল্ম, বীরুৎ, বৃক্ষ প্রভৃতি)।
পুরাণে সৃষ্টিতত্ত্ব
ব্রহ্মাণ্ড পুরাণে অষ্টবিধ সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে, যথা- মহৎ, পঞ্চভূত বা পঞ্চ-তন্মাত্র, ইন্দ্রিয়গণ, স্থাবর, তির্যকযোনি, ঊর্ধস্রোত, অর্বাকস্রোত ও অনুগ্রহ সৃষ্টি। এই অষ্টবিধ সৃষ্টির মধ্যে মহৎ, পঞ্চভূত ও ইন্দ্রিয়গণের সৃষ্টিকে প্রাকৃত-সৃষ্টি এবং স্থাবর, তির্যকযোনি, ঊর্ধস্রোত, অর্বাকস্রোত ও অনুগ্রহ এই পাঁচ প্রকার সৃষ্টিকে বৈকারিক সৃষ্টি বলে। স্থাবর সৃষ্টি বলতে বনষ্পতি, ওষধি, লতা, ত্বক্সার, বীরুৎ ও দ্রুম (বৃক্ষ) এই ছয় প্রকার উদ্ভিদ সৃষ্টিকে বোঝায়। সৃষ্টির শুরুতে যখন ব্রহ্মা ধ্যানস্থ হলেন, তখন তির্যকভাবে তীর্যকযোনি, অর্বাক বা পশ্চাৎ দিকে অর্বাকস্রোত এবং ঊর্ধভাবে ঊর্ধস্রোত সৃষ্টি হল। তমঃ প্রধান পশু-পক্ষীই তীর্যক স্রোত, সত্ত্ব-রজঃ-তমঃ গুণবিশিষ্ট মানবগণই হলেন অর্বাকস্রোত এবং দেবগণই হলেন ঊর্ধস্রোত। অনুগ্রহ সৃষ্টি বলতে দয়া, প্রসন্নতা প্রভৃতি সৃষ্টি বোঝায়।
প্রাকৃত ও বৈকারিক সৃষ্টি
ভাগবত, শিব, বিষ্ণু, ব্রহ্ম প্রভৃতি বিভিন্ন পুরাণে সৃষ্টিতত্ত্বের বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। সৃষ্টির আদিতে ঈশ্বর পুরুষ এবং প্রকৃতিতে বিভক্ত হন। প্রকৃতি সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ এই তিন গুণবিশিষ্ট। সৃষ্টির পূর্বে সত্ত্ব, রজঃ ও তমোগুণ সাম্যাবস্থায় থাকে। সৃষ্টির সময় রজোগুণের এবং প্রলয়ের সময় তমোগুণের আধিক্য ঘটে। সৃষ্টির আদিতে ঈশ্বর প্রথমে মহতত্ত্ব বা বুদ্ধিতত্ত্ব সৃষ্টি করলেন। মহতত্ত্বের সাথে তিনি ত্রিগুণ মিশিয়ে তাতে দ্রব্য, ক্রিয়া ও জ্ঞান সংযোজন করে অহংকার-তত্ত্ব সৃষ্টি করলেন। অহংকার তিন প্রকার, যথা- সাত্ত্বিক, রাজসিক এবং তামসিক। সাত্ত্বিক অহংকার হতে দিক, বায়ু, অর্ক (সূর্য), চন্দ্র, অশ্বিনীকুমার, বহ্নি (অগ্নি), ইন্দ্র, উপেন্দ্র (বিষ্ণু), মিত্র ও প্রজাপতি এই দশ দেবতা সৃষ্টি হল। এই দশ জন দেবতা মূলত দশ ইন্দ্রিয়ের অধিপতি। রাজসিক অহংকার হতে জ্ঞানশক্তি, ক্রিয়াশক্তি, দশ ইন্দ্রিয় এবং মন সৃষ্টি হল। দশ ইন্দ্রয়ের মধ্যে চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহবা ও ত্বক এই পাঁচ ইন্দ্রিয়কে জ্ঞানেন্দ্রিয় এবং বাক্ (মুখ), পাণি (হাত), পাদ, পায়ু (মলদ্বার) ও উপস্থ (জননেন্দ্রিয়) এই পাঁচ ইন্দ্রিয়কে কর্মেন্দ্রিয় বলে। চক্ষুর কর্ম দর্শন, কর্ণের কর্ম শ্রবণ, নাসিকার কর্ম আঘ্রাণ, জিহবার কর্ম আস্বাদন এবং ত্বকের কর্ম স্পর্শন। বাক্-ইন্দ্রিয়ের কর্ম বচন বা বাক্য কখন, পাণির কর্ম শিল্প, পাদের কর্ম গমন, পায়ুর কর্ম বিসর্গ বা ত্যাগ এবং উপস্থের কর্ম রমণ বা আনন্দ উপভোগ। চক্ষুর দেবতা সূর্য, কর্ণের দেবতা দিক, নাসিকার দেবতা অশ্বিনীকুমার, জিহ্বার দেবতা বরুণ, ত্বকের দেবতা বায়ু, বাকের দেবতা অগ্নি, পাণির দেবতা ইন্দ্র, পাদের দেবতা উপেন্দ্র, পায়ুর দেবতা যম, এবং উপস্থের দেবতা প্রজাপতি। মন, বুদ্ধি, অহংকার ও চিত্তকে অন্তঃকরণ বলে। মনের দেবতা চন্দ্র, বুদ্ধির দেবতা চতুর্মুখ (ব্রহ্মা), অহংকারের দেবতা শঙ্কর (শিব) এবং চিত্তের দেবতা অচ্যুত (বিষ্ণু)। তামসিক অহংকার হতে ক্ষিতি (মাটি), অপ (জল), তেজঃ (আগুন), মরুৎ (বায়ু) এবং ব্যোম (আকাশ) এই পঞ্চভূত এবং এদের গুণ পঞ্চ-তন্মাত্র (শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস এবং গন্ধ) সৃষ্টি হল। শব্দ, স্পর্শ, রূপ এবং রস এই চারটি জলের গুণ। শব্দ, স্পর্শ ও রূপ এই তিনটি আগুনের গুণ। শব্দ ও স্পর্শ এই দুটি বায়ুর গুণ। আকাশের গুণ শব্দ এবং মাটির গুণ গন্ধ। তামসিক অহংকার বিকারপ্রাপ্ত বা পরিবর্তিত হয়ে প্রথমে শব্দ তন্মাত্র উৎপন্ন হয়েছে। সে শব্দ তন্মাত্র থেকে শূন্যময় আকাশের সৃষ্টি হয়েছে। আকাশ বিকারপ্রাপ্ত হয়ে স্পর্শ তন্মাত্র সৃষ্টি হয়েছে এবং তা থেকে বায়ু সৃষ্টি হয়েছে। বায়ু বিকারপ্রাপ্ত হয়ে রূপ তন্মাত্র সৃষ্টি হয়েছে, যা থেকে অগ্নি সৃষ্টি হয়েছে। অগ্নি বিকারপ্রাপ্ত হয়ে রস তন্মাত্র সৃষ্টি হয়েছে এবং রস তন্মাত্র থেকে জল উৎপন্ন হয়েছে। জল বিকারপ্রাপ্ত হয়ে গন্ধ তন্মাত্র সৃষ্টি হয়েছে এবং তা থেকে পৃথিবী বা মাটি সৃষ্টি হয়েছে। মহতত্ত্ব থেকে মহাভূত পর্যন্ত সকল বস্ত্ত নানা শক্তি সম্পন্ন এবং পৃথক পৃথক ভূত বলে এরা সম্পূর্ণ মিলিত হতে পারল না। পৃথকভাবে নিজেদের মধ্যে মিলিত হতে না পারায় এরা প্রজা সৃষ্টি করতে অক্ষম হল। ফলে মহতত্ত্ব হতে পঞ্চ-মহাভূত পর্যন্ত সকল বস্তু মিলিত হয়ে একটি হিরণ্যময় (সোনালী) অণ্ড বা ডিম্বে পরিণত হল। সেই হিরণ্যময় অণ্ডের মধ্যে ব্রহ্মা অবস্থান করলেন। এজন্য ব্রহ্মাকে হিরণ্যগর্ভ বলা হয়। সেই হিরণ্যময় অণ্ড থেকেই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি হয়েছে। অণ্ডের উপরিভাগ থেকে ভূঃ, ভূবঃ, স্বঃ আদি সপ্তলোক এবং নিম্নভাগ থেকে অতল, বিতল আদি সপ্ত-পাতাল সৃষ্টি হয়েছে। তারপর ব্রহ্মা ক্রমে ক্রমে দশ দিক, কাল, মন, বাক্য, কাম, ক্রোধ ও রতি সৃষ্টি করলেন। ব্রহ্মা প্রজা সৃষ্টির জন্য নিজ মানস হতে মরীচি, অত্রি, অঙ্গিরা, পুলস্ত্য, পুলহ, ক্রতু এবং বশিষ্ঠ এই সপ্তঋষি সৃষ্টি করলেন। এদেরকে ব্রহ্মার মানসপুত্রও বলা হয। সপ্তঋষি ছাড়াও ব্রহ্মা সনৎকুমার আদি চার জন কুমার সৃষ্টি করলেন। তারপর ব্রহ্মা বিদুৎ, অশনি (অগ্নি), মেঘ, ইন্দ্রধনু, পক্ষীগণ ও পর্জন্য সৃষ্টি করলেন এবং তিনি যজ্ঞকার্য সম্পাদন করা জন্য বেদ সৃষ্টি করলন।
পুরাণে একথাও আছে যে, ব্রহ্মার মানসপুত্রগণ এবং সনকাদি কুমারগণ প্রজা বৃদ্ধি করতে পারছে না দেখে ব্রহ্মা নিজ দেহকে দ্বিখণ্ডিত করলেন। দেহের এক খণ্ড থেকে মনু নামক পুরুষ এবং অপর খণ্ড থেকে শতরূপা নামক প্রকৃতি (নারী) জন্ম নিলেন। এই মনু ও শতরূপা থেকে প্রজাবৃদ্ধি হতে লাগল। ব্রহ্মার দেহ থেকে উৎপন্ন বলে মনুকে স্বায়ম্ভুব বলা হয়। সায়ম্ভুব মনুর ঔরসে এবং শতরূপার গর্ভে বীর, প্রিয়ব্রত ও উত্তানপাদ নামক নামক তিনটি পুত্রের জন্ম হয়। উত্তানপাদ ধর্মের কন্যা সুনীতিকে বিবাহ করেন। সুনীতির গর্ভে ধ্রুব, কীর্তিমান, আয়ুষ্মান ও বসু নামক চার পুত্রের জন্ম হয়। ধ্রুব থেকে শিষ্টি, ভব্য ও শম্ভু নামক তিন পুত্র উৎপন্ন হয়। শিষ্টির সুচ্ছায়া নামক পত্নীর গর্ভে রিপু, রিপুঞ্জয়, বৃকল, বিপ্র ও বৃকতেজা এই পঞ্চপুত্র জন্মগ্রহণ করেন। রিপুর পুত্র চাক্ষুষের ঔরসে ও পুষ্করিণীর গর্ভে বরুণের জন্ম হয়। চাক্ষুষ মনুর ঔরসে কুৎস, পুরু, শতদ্যুম্ন, তপস্বী, সত্যবাক্, কবি, অগ্নিষ্টোম, অতিরাত্র, সুদ্যুম্ন এবং অভিমন্যু এই দশ-পুত্র জন্মলাভ করে। পুরম্ন হতে আগ্নেয়ীয় গর্ভে যে ছয়টি মহাতেজা পুত্র জন্মগ্রহণ করেন, তাঁদের নাম- অঙ্গ, সুমনস, খ্যাতি, ক্রতু, আঙ্গিরস ও গয়।
অঙ্গপত্নী সুনীথার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন বেণ। বেন রাজা ছিলেন পাপী ও অত্যাচারী। তাই মুনিগণ তাঁদের দক্ষিণ হস্ত মন্থন করে পৃথু নামক এক পুত্র সৃষ্টি করলেন। পৃথু গোরূপিণী পৃথিবীকে দোহন করে শস্যরাশি উৎপাদন করে প্রজাপালন করতে লাগলেন। পৃথুকেই বলা হয় পৃথিবীর প্রথম রাজা এবং পৃথু থেকে ‘‘পৃথিবী’’ শব্দ উৎপন্ন হয়। পৃথুর রাজত্বকালে সূত ও মগধ জাতির উৎপত্তি হয়। পৃথু রাজার অমত্মর্দ্ধি ও পাতি নামক দুই পুত্রের জন্ম হয়। অমত্মর্দ্ধির ঔরসে শিখণ্ডিনীর গর্ভে হবির্দ্ধান নামক এক পুত্র জন্মলাভ করেন। হবির্দ্ধানের প্রাচীন-বহিঃ, শুক্ল, গয়, কৃষ্ণ, ব্রজ ও অজিন নামক ছয়পুত্র উৎপন্ন হয়। প্রাচীন-বহিঃ হতে সমুদ্রকন্যা সবর্ণার গর্ভে যে দশ পুত্রের জন্ম হয়েছিল তাঁরা প্রচেতা নামে খ্যাত হলেন। সেই প্রচেতাগণের অর্ধতেজে এবং সোমের অর্ধতেজঃ বৃক্ষনন্দিনী মারিষার গর্ভে দক্ষ প্রজাপতির জন্ম হয়। দক্ষ প্রজাপতি স্থাবর, জঙ্গম, দ্বিপদ, চতুষ্পদ প্রভৃতি জীব সৃষ্টি করলেন। দক্ষের ঔরসে যে পঞ্চাশ জন কন্যার জন্ম হয়, তার মধ্যে তিনি ধর্মকে দশ জন কন্যা, কশ্যপকে ত্রয়োদশ জন কন্যা এবং সোমকে (চন্দ্র) অবশিষ্ট সাতাশ জন কন্যা দান করলেন। সেই দক্ষ-কন্যাগণ থেকে দেবতা, দানব, গো, যগ, নাগ, গন্ধর্ব, অপ্সরা প্রভৃতি জাতির উৎপত্তি হয়েছিল। দক্ষের যে দশ কন্যা ধর্মের পত্নী হয়েছিলেন তাঁরা হলেন- অরুন্ধতী, বসু, যামী, লম্বা, ভানু, মরুত্বতী, সঙ্কল্পা, মুহূর্তা, সাধ্যা, এবং বিশ্বা। বিশ্বার গর্ভে বিশ্বদেবগণ, সাধ্যার গর্ভে সাধ্য দেবতাগণ, মরুত্বতীর গর্ভে মরুত্বানগণ, ভানুর গর্ভে ভানু বা আদিত্যগণ, মুর্হূতার গর্ভে মুহূর্ত, অরুন্ধতীর গর্ভে পৃথিবী, সঙ্কল্পার গর্ভে সর্বাত্মা-সঙ্কল্প, যামীর গর্ভে নাগবীথী, বসুর গর্ভে অষ্টবসু এবং লম্বার গর্ভে ঘোষ নামক পুত্রগণের জন্ম হয়। দক্ষ যে সাতাশ জন কন্যা চন্দ্রকে দান করেছিলেন তাঁরা মূলত সাতাশ নক্ষত্র।
কশ্যপকে দান করা দক্ষে ত্রয়োদশ কন্যা নাম- অদিতি, দিতি, দনু, অরিষ্টা, সুরসা, খসা, সুরভি, বিনতা, তাম্রা, ক্রোধবশা, ইলা, কদ্রু ও মুনি। কাশ্যপের ঔরসে দক্ষকন্যা অদিতির গর্ভে বিষ্ণু, শক্র, অর্যমা, ধাতা, বিধাতা, ত্বষ্টা, পূষা, বিবস্বান, সবিতা, মিত্রাবরুণ, অংশ ও ভগ এই দ্বাদশ আদিত্যের জন্ম হয়। দিতির গর্ভে হিরণ্যকশিপু ও হিরণ্যাক্ষ নামক দুই দৈত্য এবং সিংহিকা নামক এক রাক্ষসীর জন্ম হয়। হিরণ্যকশিপুর চার পুত্র, যথা- হ্রাদ, অনুহ্রাদ, প্রহ্লাদ ও সংহ্রাদ। হিরণ্যাক্ষের পাঁচ পুত্র, যথা- উর্জর, শকুনি, ভূতসমত্মাপন, মহানাভ ও কালনাভ। দনুর শতপুত্রের মধ্যে দ্বিমুর্দ্ধা, শুঙ্কুকর্ণ, হয়শিরা, অয়োমুখ, শম্বর, কপিল, বামন, মারীচি, মেঘবান, ইল্বল, খসৃম, বিক্ষোভন, কেতু, কেতুবীর্য, শতহ্রদ, ইন্দ্রিজিৎ, সর্বজিৎ, বজ্রনাভ, একচক্র, তারক, বৈশ্বানর, পুলোমা, বিদ্রাবণ, মহাসুর, স্বর্ভানু, বৃষপর্বা ও বিপ্রচিত্তি প্রধান। এরা সকলে মহাবল সম্পন্ন দানব। তাম্রার গর্ভে ক্রৌঞ্চা, শ্যেনী, ভাসী, সুগ্রীবী, শুচি, ও গৃধী নামক ছয় কন্যার জন্ম হয়। কশ্যপের ঔরসে বিনতার গর্ভে অরুণ ও গরুড় নামক দুই পক্ষীর জন্ম হয়। সুরসার গর্ভে সহস্র সর্পের এবং কদ্রুর গর্ভে অনন্ত, বাসুকি, তক্ষক, শঙ্খ, কর্কোটক, ধনঞ্জয়, বলাহক আদি সহস্র নাগের জন্ম হয়। সুরভির সন্তান গো ও মহিষী সকল এবং ইলার সমত্মান বিবিধ বৃক্ষ, লতা, বলস্নী ও তৃণজাতি। খসার গর্ভে যক্ষ ও রক্ষগণের, মুনির গর্ভে অপ্সরাগণের এবং অরিষ্টার গর্ভে গন্ধর্বগণের জন্ম হয়। ক্রোধবশা বা ধরার গর্ভে অসংখ্য জলপক্ষীগণের জন্ম হয়।
ষড়-দর্শনে সৃষ্টিতত্ত্ব
বিভিন্ন পুরাণশাস্ত্রও সাংখ্য-দর্শনের সৃষ্টিতত্ত্বকে স্বীকার করেছে। প্রকৃতি ও পুরুষের সংযোগে জগৎ সৃষ্টি হয়। প্রকৃতি জড়, সগুণা, পরিণামী এবং ক্রিয়াশীল কিন্তু পুরম্নষ নির্গুণ, চৈতন্যময়, অপরিণামী এবং নিষ্কৃয়। প্রকৃতির তিনগুণ, যথা- সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ। এই সত্ত্বগুণ জ্ঞান প্রকাশক। রজোগুণ গতিশীল এবং উত্তেজক। রজোগুণ নিজে গতিশীল এবং অন্যকেও গতিশীল করে। তমোগুণ আবরক, জড় এবং অসার। তমোগুণ কোন বস্তুতে আলস্য, জড়ত্ব এবং অজ্ঞানতা সৃষ্টি করে। সত্ত্বগুণ সুখ সরূপ, রজোগুণ দুঃখ স্বরূপ এবং তমোগুণ মোহ স্বরূপ। এই তিনগুণের সাম্যাবস্থাই প্রকৃতি। প্রকৃতির রজোগুণ ক্রিয়াশীল হলে সৃষ্টিকার্য শুরু হয়। পুরুষ ও প্রকৃতির সংযোগ ঘটলে রজোগুণের মধ্যে বিক্ষোভ বা আলোড়ন শুরম্ন হয়। রজোগুণ আলোড়িত হওয়ার পর সত্ত্ব ও তমোগুণকেও আলোড়িত করে। ফলে এই গুণগুলোর বিভিন্ন পরিমাণে সংযোগ ঘটতে থাকে এবং জাগতিক বস্তু সৃষ্টি হতে থাকে। প্রকৃতি থেকে প্রথমে মহৎ-তত্ত্ব, পরে মহৎ-তত্ত্ব থেকে অহঙ্কার-তত্ত্ব, অহঙ্কার-তত্ত্ব থেকে পঞ্চ-জ্ঞানেন্দ্রিয় (মাটি, জল, আগুন, বায়ু ও আকাশ), পঞ্চ-কর্মেন্দ্রিয় (হস্ত, মুখ, পদ, পায়ু ও জননেন্দ্রিয়), মন ও পঞ্চ-তন্মাত্র (পঞ্চভূতের গুণ) উৎপত্তি হয়। পঞ্চ-তন্মাত্র (শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস ও গন্ধ) থেকে পঞ্চভূত সৃষ্টি হয়। সাংখ্য মতে পঞ্চ-জ্ঞানেন্দ্রিয় এবং পঞ্চ-কর্মেন্দ্রিয় এই দশ ইন্দ্রিয়কে বাহ্যকরণ বলে এবং মন, বুদ্ধি, অহংকার, চিত্ত তিনটিকে অন্তঃকরণ বলে। সাংখ্য মতে প্রকৃতি, পঞ্চ-মহাভূত, ত্রয়োদশ-করণ (দশটি বাহ্যকরণ ও তিনটি অন্তঃকরণ) এবং পঞ্চ-তন্মাত্র এই চতুর্বিংশতি তত্ত্ব থেকে জগৎ সৃষ্টি হয়েছে।
বৈশেষিক দর্শনমতে পৃথিবী (মাটি), জল, অগ্নি ও বায়ু এই চারটি পরমাণুর সংযোগে জগৎ সৃষ্টি হয়েছে। দুটি পরমাণু মিলিত হয়ে দ্ব্যণুক এবং তিনটি পরমাণু মিলিত হয়ে ত্র্যণুক বা ত্রসরেণু গঠিত হয়। বায়ু পরমাণুগুলো কম্পিত ও গতিশীল হয়ে প্রথমে দ্ব্যণুক ও ত্র্যণুক গঠন করে। পরে এই দ্ব্যণুক ও ত্র্যণুকের সংযোগেই বায়ু মহাভূত উৎপন্ন হয়। একইভাবে জল, অগ্নি ও পৃথিবী মহাভূত উৎপন্ন হয়। এই পরমাণুর কম্পন ও সংযোগ ঘটায় ঈশ্বর। অর্থাৎ ঈশ্বরের ইচ্ছায় পরমাণুর কম্পনে অণু এবং অণু থেকে সকল যোগিক পদার্থ উৎপন্ন হয়।
বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ মতে জগৎ ঈশ্বরের দেহ স্বরূপ। অর্থাৎ জগৎ ঈশ্বর থেকে বিচ্ছিন্ন নয় আবার জগৎ ঈশ্বরও নয়। ঈশ্বরের অচিৎ বা জড় অংশ বিকারপ্রাপ্ত হয়ে জগতে পরিণত হয়েছে। তবে অদ্বৈতবেদামত্ম মতে কোন কিছুই সৃষ্টি হয়নি। ঈশ্বর অজর, অমর, অবিনাশী এবং অপরিণামী। কোন কিছু সৃষ্টি করতে জড় উপাদান প্রয়োজন। ঈশ্বর যেহেতু অজড় তাই ঈশ্বরের কোন জড় উপাদান থাকতে পারে না, ফলে ঈশ্বর কতৃর্ক কোন কিছু সৃষ্টিও অসম্ভব। তাছাড়া ঈশ্বর থেকে কোন কিছু সৃষ্টি হতে গেলে তাঁর বিকার বা পরিণাম ঘটতে হবে। ঈশ্বর যেহেতু বিকারশীল বা পরিণামী নয়, সেহেতু ঈশ্বর কর্তৃক কোন কিছু সৃষ্টি হতে পারে না। বস্ত্তত যা কিছুই সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে হচ্ছে, তা সত্য নয় অর্থাৎ তা ভ্রম বা মায়া। মায়ার কারণেই সকলে ঈশ্বরকে জগৎ মনে করছে।
কাল ও কল্প সৃষ্টি
চোখের পাতা পড়তে যে সময় লাগে তাকে নিমেষ বলে। পনের নিমেষে এক কাষ্ঠা, ত্রিশ কাষ্ঠায় এক কলা, ত্রিশ কলায় এক মূহূর্ত, ত্রিশ মুহূর্তে এক দিবারাত্রি হয়। সাত দিনে এক সপ্তাহ, পনের দিনে এক পক্ষ এবং ত্রিশ দিনে এক মাস হয়। তিনশত-পয়ষট্টি দিনে বা বার মাসে এক বৎসর হয়। পক্ষ দুটি, যথা- কৃষ্ণপক্ষ ও শুক্লপক্ষ। শুক্লপক্ষে পিতৃলোকের দিন এবং কৃষ্ণপক্ষে পিতৃলোকের রাত হয়। এক বৎসরে দুটি অয়ন, যথা- দক্ষিণায়ণ ও উত্তরায়ণ। পৌষ মাসের উত্থান একাদশী থেকে আষাঢ় মাসের শয়ান একাদশী পর্যন্ত এই ছয় মাস উত্তরায়ণ এবং অবশিষ্ট ছয় মাস দক্ষিণায়ণ। উত্তরায়ণে সূর্য উত্তরদিকে এবং দক্ষিণায়ণে সূর্য দক্ষিণদিকে গমন করেন। উত্তরায়ণের ছয় মাসে দেবতাদের এক দিন এবং দক্ষিণায়ণের ছয় মাসে দেবতাদের এক রাত হয়। উত্তরায়ণে দেবতারা জাগ্রত থাকেন এবং দক্ষিণায়ণে দেবতারা নিদ্রা যান। অতএব মর্ত্যলোকের এক বৎসরে দেবতাদের এক দিন (দিবারাত্র) এবং তিনশত ষাট বৎসরে দেবতাদের এক বৎসর হয়। সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলি এই চার প্রকার যুগ রয়েছে। সত্য যুগের আয়ু ৪,৮০০ দৈববৎসর বা মনুষ্যলোকের ১৭,২৮,০০০ বৎসর। চারশত দৈববৎসরে সত্য যুগের সন্ধ্যা হয় এবং চারশত দৈববৎসরে সত্য যুগের সন্ধ্যাংশ হয়। ত্রেতা যুগের আয়ু ৩৬০০ দৈববৎসর বা মনুষ্যলোকের ১২,৯৬,০০০ বৎসর। তিনশত দৈববৎসরে ত্রেতা যুগের সন্ধ্যা এবং তিনশত দৈববৎসরে ত্রেতা যুগের সন্ধ্যাংশ হয়। দ্বাপর যুগের পরিমান ২৪০০ দৈববৎসর বা মনুষ্যলোকের ৮,৬৪,০০০ বৎসর। দুইশত দৈববৎসরে দ্বাপরযুগের সন্ধ্যা এবং দুইশত দৈববৎসরে দ্বাপর যুগের সন্ধ্যাংশ হয়। কলি যুগের আয়ু ১২০০ দৈববৎসর বা মুনুষ্যলোকের ৪,৩২,০০০ বৎসর। একশত দৈব বৎসরে কলিযুগের সন্ধ্যা এবং একশত দৈববৎসরে কলিযুগের সন্ধ্যাংশ হয়। চার যুগের মোট পরিমান বার হাজার দৈববৎসর এবং এই বার হাজার দৈববৎসরে দেবতাদের এক যু্গ হয়। দেবতাদের এক হাজার যুগে অর্থাৎ পৃথিবীর ৪,৩২,০০,০০,০০০ বৎসরে ব্রহ্মার একদিন এবং সম সংখ্যক বৎসরে ব্রহ্মার এক রাত হয়। ব্রহ্মার দিনে ব্রহ্মা- সৃষ্টি হয় এবং রাতে তা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। সাত দৈবযুগে অর্থাৎ আটলক্ষ বাহান্ন দৈববৎসরে বা মানুষের হিসেবে ত্রিশকোটি সাতষট্টিলক্ষ কুড়িহাজার বৎসরে এক মন্বন্তর হয়। চতুর্দশ মন্বন্তরে হয় এক কল্প। সহজ কথায় ব্রহ্মার দিনকেই কল্প বলে।
মন্বন্তর সৃষ্টি
চতুর্দশ মন্বন্তরে যে চতুর্দশ জন মনু প্রজাপালন করেন, তাঁরা হলেন- স্বায়ম্ভুব, স্বরোচিষ, উত্তম, তামস, রৈবত, চাক্ষুষ, বৈবস্বত (সত্যব্রত), সাবর্ণি, দক্ষসাবর্ণি, ধর্মসাবর্ণি, রুদ্রসাবর্ণি, দেবতাসাবর্ণি এবং ইন্দ্রসাবর্ণি। স্বয়ম্ভুব মনু হলেন প্রথম মনু। স্বয়ং ব্রহ্মা নিজেকে দ্বিধা বিভক্ত করে স্বয়ম্ভুব মনু ও শতরূপাকে সৃষ্টি করেছেন। ভগবত মতে স্বয়ম্ভুব মনুর ঔরসে এবং শতরূপার গর্ভে প্রিয়ব্রত ও উত্তানপাদ নামক দুই পুত্রের এবং আকূতি, দেবাহূতি, ও প্রসূতি নামক তিন কন্যার জন্ম হয়। দ্বিতীয় মনু স্বরোচিষ হলেন অগ্নির পুত্র। তাঁর দুই পুত্রের নাম সুষেণ ও রোচিষ্মৎ। এই মন্বন্তরে তুষিতাদি দেবতা, রোচন নামক ইন্দ্র এবং ঊর্ধ, স্তম্ভাদি সপ্তর্ষি ছিলেন। তৃতীয় মনু উত্তম হলেন প্রিয়ব্রতের পুত্র। উত্তমের পুত্রগণের নাম- পবন, সৃঞ্জয় এবং যজ্ঞহোত্রাদি। এই মন্বন্তরে সত্য, বেদশ্রুত, ভদ্র প্রভৃতি দেবতা, সত্যজিৎ নামক ইন্দ্র এবং প্রমদ আদি সম্পর্ষি ছিলেন। চতুর্থ মনু তামস হলেন উত্তমের ভ্রাতা। তামসের পৃথু, খ্যাতি, নর, কেতু প্রভৃতি পুত্র ছিল। এই মনুর সময়ে সত্যক, হরি ও বীর নামক দেবতা, ত্রিশিখ নামক ইন্দ্র এবং জ্যোতির্ধামাদি সপ্তর্ষি ছিলেন। পঞ্চম মনু রৈবত হলেন তামসের ভ্রাতা। রৈবতের পুত্রগণের নাম অর্জুন, বলি ও বিন্ধ্যাদি। এই মন্বন্তরে ভূতরয়াদি দেবতা, বিভু নামক ইন্দ্র এবং হিরণ্যরোমা, বেদশিরা, ঊর্ধবাহু প্রভৃতি ব্রাহ্মণগণ ছিলেন। ষষ্ঠ মনু চাক্ষুষ হলেন চক্ষুষের পুত্র। তাঁর পুত্রগণের নাম পুরু, পুরুষ, সুদ্যুমণ প্রভৃতি। এই মনুর সময়ে আপ্যাদিগণ দেবতা, মন্ত্রদ্রুম নামক ইন্দ্র এবং হর্যস্মৎ ও কীরকাদি সপ্তর্ষি ছিলেন। বিবস্বানের পুত্র বৈবস্বত হলেন সপ্তম মনু। বৈবস্বতের দশটি পুত্র, যথা- ইক্ষ্বাকু, নভাগ, ধৃষ্ট, শর্যাতি, নরিষ্যস্ত, নাভাগ, দিষ্ট, করুষ, পৃষধ্র এবং বসুমান্। এই মন্বমন্তরে আদিত্য, বসু, রুদ্র, বিশ্বদেবগণ, মরুদগণ, অশ্বিনীকুমার, ঋভু প্রভৃতি দেবতা, পুরন্দর নামক ইন্দ্র এবং কশ্যপ, অত্রি, বশিষ্ঠ, বিশ্বামিত্র, গোতম, জমদগ্নি এবং ভরদ্বাজ এই সপ্ত ঋষি রয়েছেন। অষ্টম মনু সাবর্ণির ঔরসে নির্মোক এবং বিরজস্ক নামক পুত্রদ্বয়ের জন্ম হবে। এই মনুর সময়ে সুতপা, বিরজা আনৃতপ্রভা প্রভৃতি দেবতা, বিরোচনপুত্র বলি নামক ইন্দ্র এবং গালব, দীপ্তিমান, পরশুরাম, অশ্বত্থামা, কৃপ, ঋষ্যশৃঙ্গ এবং বদরায়ণ নামক সপ্তর্ষি থাকবে। নবম মনু বরুণপুত্র দক্ষসাবর্ণি ভূতকেতু, দীপ্তকেতু প্রভৃতি পুত্রলাভ করবেন। ঐ মন্বন্তরে মরীচি, গর্ভ প্রভৃতি দেবতা, অদ্ভূত নামক ইন্দ্র এবং দ্যুতিমান প্রভৃতি সপ্তর্ষি থাকবে। দশম মনু ব্রহ্মসাবর্ণি উপশ্লোকের পুত্র রূপে জন্ম নেবেন। তাঁর ভূরিষেণ আদি পুত্র থাকবে। ঐ মনুর সময় সুবাসন, অবিরুদ্ধাদি দেবতা, শম্ভু নামক ইন্দ্র এবং হবিষ্মান, সুকৃত্য, সত্য, জয়, মূর্তি প্রভৃতি সপ্তর্ষি থাকবে। একাদশ মনু ধর্মসাবর্ণির সত্য, ধর্ম আদি দশপুত্র থাকবে। ঐ মন্বন্তরে বিহঙ্গম, কালগণ ও রূচি প্রভৃতি দেবতা, বৈধৃত নামক ইন্দ্র এবং অরুণাদি সপ্তর্ষি থাকবে। দ্বাদশ মনু রুদ্রসাবর্ণির ঔরসে দেবযান, উপদেব প্রভৃতি পুত্রের জন্ম হনে। ঐ মন্বমন্তরে হরিতাদি দেবতা, গন্ধধামা নামক ইন্দ্র এবং তপোমূর্তি, তপস্বী, অগ্নীধ্র প্রভৃতি সপ্তর্ষি থাকবে। দেবসাবর্ণি ত্রয়োদশ মনু হবেন এবং তাঁর চিত্রসেন, বিচিত্র প্রভৃতি পুত্র থাকবে। ঐ মন্বন্তরে সুকর্মা, সুত্রামাদি দেবতা, দিবস্পতি নামক ইন্দ্র এবং নির্মোক, তত্ত্বদর্শ প্রভৃতি সপ্তর্ষি থাকবে। সর্বশেষ অর্থাৎ চতুর্দশ মনু ইন্দ্রসাবর্ণি ঊরু, গম্ভীর, ব্রধণ আদি পুত্র উৎপন্ন করবেন। ঐ মন্বন্তরে চাক্ষুষ প্রভৃতি দেবতা, শুচি নামক ইন্দ্র এবং অগ্নিবাহু, শুদ্ধ, মাগধ প্রভৃতি সপ্তর্ষি থাকবে। বর্তমান কল্পের নাম বারাহ কল্প এবং এই কল্পে সপ্তম মনু বৈবস্বতের শাসন চলছে।
সপ্তদ্বীপ ও বর্ষ সৃষ্টি
ব্রহ্মা পৃথিবীতে সাতটি দ্বীপ সৃষ্টি করেছেন, যথা- জম্বু, প্রক্ষ, শাল্মল, কুশ, ক্রৌঞ্চ, শাক ও পুষ্কর এবং এই সপ্তদ্বীপ যথাক্রমে লবণ, ইক্ষু, সুরা, ঘৃত, দধি, দুগ্ধ এবং জল এই সপ্তসমুদ্র দ্বারা পরিবেষ্টিত। সপ্তদ্বীপের মধ্যভাগে জম্বুদ্বীপ অবস্থিত। জম্বুদ্বীপের মধ্যভাগে চুরাশী-সহস্র যোজন পরিমাণ উচ্চতা বিশিষ্টি সুমেরু পর্বত অবস্থিত। সুমেরু পর্বতের দক্ষিণে হিামালয়, হেমকুট ও নিষাধ পর্বত এবং উত্তরে নীল, শ্বেত ও শৃঙ্খী পর্বত অবস্থিত। সুমের পর্বতের চারিদিকে মন্দার, গন্ধমাদন, সুপার্শ্ব ও বিপুল নামক চারটি পর্বত রয়েছে। ঐ সব পর্বতের উপর আম্র, জম্বু (জাম), কদম্ব ও বট এই চার প্রকার বিশাল বৃক্ষ আছে এবং ঐ বৃক্ষগুলোর নিকটে অরুণোদ, মহাভদ্র, অসিতোদ ও মানস নামক চারটি বিশাল সরোবর (হ্রদ) আছে। সুমেরুর পূর্বদিকে চৈত্ররথ বন, পশ্চিমে বৈভ্রাজক বন, উত্তরে নন্দনকানন এবং দক্ষিণে গন্ধমাদন বন অবস্থিত। জম্বুদ্বীপ সাতটি বর্ষে বা স্থানে বিভক্ত, যথা- ভারতবর্ষ, কিম্পুরুষবর্ষ, হরিবর্ষ, কুরুবর্ষ, ইলাবৃত্তবর্ষ, ভদ্রাশ্ববর্ষ ও কেতুমালবর্ষ। এই সপ্ত-স্থানের মধ্যে ভারতবর্ষ শ্রেষ্ঠ। বিষ্ণুপুরাণে উল্লেখ আছে, ‘‘জম্বুদ্বীপের মধ্যে ভারতবর্ষই সর্বশ্রেষ্ঠ কারণ এই ভারতবর্ষই প্রকৃত ধর্মভূমি ও কর্মভূমি। জগতের অন্য সমস্ত স্থান ভোগভূমি। সহস্র সহস্র জন্মের পর এবং বহুজন্মের পুন্যফলে জীবগণ কদাচিৎ এই ভারতবর্ষে মনুষ্য-জন্ম লাভ করে’’।
প্রলয়
সৃষ্টি ও প্রলয় মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। যার সৃষ্টি আছে তার প্রলয়ও আছে। তাই জগতেরও একদিন প্রলয় ঘটবে। প্রলয় চতুর্বিধ, যথা- নিত্য, নৈমিত্তিক, প্রাকৃত ও আত্যমিত্মক প্রলয়। এই জগতে প্রতিদিন সুষুপ্তি বা স্বপ্নহীন নিদ্রার সময় সমস্ত ভূতের যে লয় হয়ে থাকে, তাকে নিত্য প্রলয় বলে। কল্প অমেত্ম ব্রহ্মার নিদ্রাগমনের সময়কে ব্রহ্মার রাত্রি বলে। ঐ ব্রহ্মার রাত্রিতে মর্ত্য, অন্তরীক্ষ ও স্বর্গ এই ত্রিলোকের যে লয় হয়, তাকে নৈমিত্তিক প্রলয় বলে। মহৎ, পঞ্চ-তন্মাত্র, পঞ্চভূত, ইন্দ্রিয় প্রভৃতি প্রাকৃত-সৃষ্টির যে লয় হয়, তাকে প্রাকৃত প্রলয় বলে। তত্ত্বজ্ঞানী যোগীগণের আত্মা যখন পরমাত্মাতে লয় হয়, তখন তাকে আত্যন্তিক প্রলয় বলে।
ওঁ পূর্ণমদঃ পূর্ণমিদং পূর্ণাত্ পূর্ণমুদচ্যতে।
পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে
সরলার্থ : উহা (পরব্রহ্ম) পূর্ণ, ইহা (নামরূপে স্থিত ব্রহ্ম) পূর্ণ; এই সকল সূক্ষ্ম ও স্থূল পদার্থ পরিপূর্ণ ব্রহ্ম হইতে উদগত বা অভিব্যক্ত হইয়াছে। আর সেই পূর্ণস্বভাব ব্রহ্ম হইতে পূর্ণত্ব গ্রহণ করিলেও পূর্ণই অর্থাৎ পরব্রহ্মই অবশিষ্ট থাকেন। ত্রিবিধ বিঘ্নের (আধ্যাত্মিক, আধিদৈবিক ও আধিভৌতিক) শান্তি হোক। ঈশ উপনিষদ। শান্তিপাঠ। [অতুলচন্দ্র সেন, সীতানাথ তত্ত্বভূষণ, মহেশচন্দ্র কর্তৃক অনূদিত ও সম্পাদিত- উপনিষদের অখণ্ড সংস্করণ থেকে উদ্ধৃত করা হলো।]
উপনিষদে বর্ণিত ব্রহ্ম অদ্বিতীয় সত্তা। ইনি সূক্ষ্ম ও স্থূল সকল কিছূরই উত্স। এই উত্স থেকে জগতের বিভিন্ন উপকরণের সৃষ্টি হয়। এর সমর্থন পাওয়া যায় অন্যান্য হিন্দু ধর্মগ্রন্থে। যেমন- মার্কেণ্ডয় পুরাণে আছে-
যা অব্যক্ত এবং ঋষিরা যাকে প্রকৃতি বলে থাকেন, যা ক্ষয় বা জীর্ণ হয় না, রূপ রস গন্ধ শব্দ ও স্পর্শহীন, যার আদি অন্ত নেই, যেখান থেকে জগতের উদ্ভব হয়েছে, যা চিরকাল আছে এবং যার বিনাশ নেই, যার স্বরূপ জানা যায় না, সেই ব্রহ্ম সবার আগে বিরাজমান থাকেন। মার্কেণ্ডয় পুরাণ/শ্রীসুবোধকুমার চক্রবর্তৗ।
উপনিষদ ও মার্কেণ্ডয় পুরাণ অনুসারে- দেখা যাচ্ছে, সৃষ্টির আদিতে পরমব্রহ্ম বিরাজ করেন। এবং সেই পরমব্রহ্ম থেকেই জগতের সব কিছু সৃষ্টি হয়। এই সৃষ্টি প্রক্রিয়ার স্তরগুলো সম্পর্কে মার্কেণ্ডয় পুরাণে যা বিবৃত হয়েছে, তা হলো-
সত্ত্ব (প্রকৃতি) রজ (যার প্রভাবে অহংকারসহ অন্যান্য মন্দগুণের জন্ম হয়) ও তম (অন্ধকার) এই তিন গুণ তাঁর মধ্যে পরস্পরের অনুকূলে ও অব্যাঘাতে অধিষ্ঠিত আছে। সৃষ্টির সময়ে তিনি (ব্রহ্ম) এই গুণের সাহায্যে সৃষ্টিক্রিয়ায় প্রবৃত্ত হলে প্রধান তত্ত্ব প্রাদুর্ভূত হয়ে মহত্তত্ত্বকে (মহৎ নামক তত্ত্ব) আবৃত করে। এই মহত্তত্ত্ব তিনগুণের ভেদে তিন প্রকার। এর থেকে তিন প্রকার ত্রিবিধ অহঙ্কার প্রাদুর্ভূত হয়। এই অহঙ্কারও মহত্তত্ত্বে আবৃত ও তার প্রভাবে বিকৃত হয়ে শব্দতন্মাত্রের সৃষ্টি করে। তা থেকেই শব্দ লক্ষণ আকাশের জন্ম। অহঙ্কার শব্দমাত্র আকাশকে আবৃত করে এবং তাতেই স্পর্শতন্মাত্রের জন্ম। এতে বলবান বায়ু প্রাদুর্ভূত হয়। স্পর্শই বায়ুর গুণ। শব্দমাত্র আকাশ যখন স্পর্শমাত্রকে আবৃত করে, তখন বায়ু বিকৃত হয়ে রূপমাত্রের সৃষ্টি করে। বায়ু থেকে জ্যোতির উদ্ভব, রূপ ঐ জ্যোতির গুণ। স্পর্শমাত্র বায়ু যখন রূপমাত্রকে আবৃত করে, তখন জ্যোতি বিকৃত হয়ে রসমাত্রের সৃষ্টি করে। তাতেই রসাত্মক জলের উদ্ভব। সেই রসাত্মক জল যখন রূপমাত্রকে আবৃত করে তখন জল বিকৃত হয়ে গন্ধমাত্রের সৃষ্টি করে। তাতেই পৃথিবীর জন্ম হয়। মার্কেণ্ডয় পুরাণ/শ্রীসুবোধকুমার চক্রবর্তৗ।
পুরাণের এই বিবৃত থেকে বুঝা যায় ব্রহ্মা প্রকৃতিকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় রূপান্তর করে পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন।
মহাভারতের আদিপর্বের সৃষ্টিবর্ণন অংশের- সৃষ্টি তত্ত্ব থেকে যে ধারণা পাই তা কিছুটা আধুনিক বিজ্ঞানের সমার্থক বলেই বোধ হয়। আধুনিক বিজ্ঞান বলে- আদিতে বস্তুপুঞ্জ একত্রিত হয়ে একটি পিণ্ডের সৃষ্টি হয়েছিল। উক্ত পিণ্ডের বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে বর্তমান মহাবিশ্বের জন্ম হয়েছিল। তবে মহাভারতে এর সাথে ঐশ্বরিক সত্তার মহিমা যুক্ত করার কারণে- এই বর্ণনা ভিন্ন মাত্রায় রূপ পরিগ্রহ করেছে। যেমন-
প্রথমতঃ এই বিশ্বসংসার কেবল ঘোরতর অন্ধকারে আবৃত ছিল। অনন্তর সমস্ত বস্তুর বীজভূত এক অণ্ড প্রসূত হইল। ঐ অণ্ডে অনাদি, অনন্ত, অচিন্তনীয়, অনির্বচনীয়, সত্যস্বরূপ নিরাকার, নির্বিকার, জ্যোতির্ময় ব্রহ্ম প্রবিষ্ট হইলেন। অনন্তর ঐ অণ্ডে ভগবান্ প্রজাপতি ব্রহ্মা স্বয়ং জন্ম পরিগ্রহ করিলেন। তত্পরে স্থাণু, স্বায়ম্ভু মনু দশ প্রচেতা, দক্ষ, দক্ষের সপ্ত পুত্র, সপ্তর্ষি, চতুর্দশ মনু জন্মলাভ করিলেন। মহর্ষিগণ একতানমনে যাঁর গুণকীর্তন করিয়া থাকেন, সেই অপ্রমেয় পুরুষ, দশ বিশ্বদেব, দ্বাদশ আদিত্য, অষ্টবসু, যমজ অশ্বিনীকুমার, যক্ষ, সাধুগণ, পিশাচ, গুহ্যক এবং পিতৃগণ উত্পন্ন হইলেন। তত্পরে জল, পৃথিবী, বায়ু, আকাশ, দশ দিক্, সংবত্সর, ঋতু, মাস, পক্ষ, রাত্রি ও অন্যান্য বস্ত ক্রমশঃ সঞ্চাত হইল। (কালীপ্রসন্নসিংহ কর্তৃক অনূদিত সংস্করণ থেকে।)
হিন্দু ধর্মগ্রন্থগুলোতে সৃষ্টি-তত্ত্বের রূপ মোটামুটি এই ভাবেই বিবৃত হয়েছে। এই সকল বর্ণনা অনুসারে যে সার কথা পাওয়া যায় তা হলো- আদিতে ব্রহ্ম নামক পরম সত্তা ছিল। উক্ত সত্তা প্রকৃতিকে একটি বিশাল অণ্ডে রূপান্তরিত করলেন। উক্ত অণ্ড থেকে সৃষ্টি হয়েছিল বিশ্ব-চরাচর এবং দেবতাসহ অন্যান্য সকল প্রাণী।
সুত্র ধরে---
আদিকাল থেকে এখনো পর্যন্ত এ যেন মানুষের এক অনন্ত জিজ্ঞাসা।
সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে বেদ এর বিখ্যাত নাসাদিয় সুক্ত এবং হিরন্যগর্ভ সুক্ত এর কথা অনেকেই জানেন।ধর্মবিশেষজ্ঞ ও বিজ্ঞানী মহলে বহুল আলোচিত এই দুটি সুক্তের আলোকে সৃষ্টিতত্ত্ব সংক্ষেপে আলোচনা করা হল-
ঋগবেদ ১০/১২৯/১
"নাসাদাসিস নঃ সদাসিত্ তদানীম নাসিদ রজ ন ব্যামাপ্রো যৎ..."
"শুরুতে কোন অস্তিত্ব(সৎ) বা অনস্তিত্ব(অসৎ) ছিলনা।সেখানে ছিলনা কোন বায়ুমন্ডল"
ঋগবেদ ১০/১২৯/৩
"তম অসিৎ তমস... তপসস্তন্মহিনাজায়াতৈকম”
"চারদিক ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন। সমস্ত জিনিস একত্রে পুন্জীভুত ছিল।সেখান থেকে প্রচন্ড তাপের সৃষ্টি হল"
একইভাবে
ঋগবেদ ১০/১২১/১
"হিরন্যগর্ভ সামাভরতাগ্রে.."
"প্রথমেই হিরন্যগর্ভ সৃষ্টি হল"
ঋগবেদ ১০/১২১/৭
"আপ হ য়দ বৃহাতিরিবিশ্বমা য়ান গর্ভম..."
"সেই হিরন্যগের্ভ ছিল উত্তপ্ত তরল যাতে ছিল সৃষ্টির সমস্ত বীজ"
একই ধরনের কথা বলছে শতপথ ব্রাক্ষ্মন ১১.১.৬.১
"হিরন্যগর্ভানি অপঃ তে সলিলা..."
"প্রথমে হিরন্যগর্ভ সৃষ্টিহল।সেখানে ছিল উত্তপ্ত গলিত তরল।এটি ছিল মহাশুন্যে ভাসমান।বছরের পরবছর এই অবস্থায় অতিক্রান্ত হয়।"
ঋগবেদ ১০.৭২.২
"তারপর যেখানে বিস্ফোরন ঘটল গলিত পদার্থ থেকে,বিন্দু থেকে যেন সব প্রসারিত হতে শুরু হল"
ঋগবেদ ১০.৭২.৩
"সেই বিস্ফোরিত অংশসমূহ থেকে বিভিন্ন গ্রহ,নক্ষত্র তৈরী হল"
ঋগবেদ ১০.৭২.৪
"তার এক জীবনপ্রদ অংশ থেকে পৃথিবী সৃষ্টি হল"
ঋগবেদ ১০.৭২.৮-৯
"তারপর সৃষ্ট ক্ষেত্রে সাতধাপে সংকোচন-প্রসারন সম্পন্ন হল।তারপর সৃষ্টি হল ভারসাম্যের।"
এই অংশটুকু পরলেই স্পষ্ট বোঝা যায় বেদের সৃষ্টিতত্ত আধুনিক বিজ্ঞানের সাথে কতটুকু সামঞ্জস্যপূর্ণ।সৃষ্টিতত্তের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মডেল “Lambda-CDM Concordance Model” অনুযায়ী “the evolution of the universe from a very uniform, hot, dense primordial state to its present অর্থাৎ একটি উত্তপ্ত, কেন্দ্রীভূত আদি অবস্থা থেকেই বর্তমান অবস্থার উত্থান।”এছাড়া বেদ এ উল্লেখিত বিস্ফোরণ বর্তমান বিশ্বের বহুল আলোচিত বিগ ব্যাংগ তত্তের সাথে প্রায় পুরোপুরি মিলে যায়।
আশ্চর্যের এখানেই শেষ নয়।বেদ এর মতে সৃষ্টির শুরুতেই ওঁম উচ্চারিত হয় আর এর প্রভাবেই হয় বিস্ফোরন ।
বেদান্ত সূত্র(4/22)
"অনাবৃতিঃ শব্দহম"
অর্থাৎ শব্দের মাধ্যমেই সৃষ্টির শুরু যা মাত্র দুই বছর আগে বিজ্ঞানীরা আবিস্কার করেছেন।
বিজ্ঞানীদের দেয়া নতুন STRING THEORY অনুযায়ী প্রথমেই একটা অতি নিম্ন তড়ঙ্গ দৈর্ঘ্য এর শব্দ তড়ঙ্গ তৈরী হয় যার ধাক্কায় বিস্ফোরণ শুরু হয়!
তাই বেদের সৃষ্টিতত্ত পড়ে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় এর Dr. Kevin Hurley বলেছিলেন
"How could Aryan sages have known all this 6000 years ago, when scientists have only recently discovered this using advanced equipments which didn't exist that time!"
তথ্যসূত্র VEDA, The infallible word of GOD
বিজ্ঞান আর ধর্ম ‘ – এই দুই উপাদান মিলিয়েই আমাদের বিশ্বাস। কিন্তু প্রায়ই নান বিষয়ে ধর্ম আর বিজ্ঞানের মধ্যে লেগে যায় ঠোকাঠুকি। বিজ্ঞান বিশ্বাস করতে গেলে ধর্ম থাকে না, আবার ধর্মীয় মতবাদ মানতে চাইলে হতে হয় পশ্চাদগামী।
মহাবিশ্বে সৃষ্টি নিয়ে বৈজ্ঞানিক মতবাদ ’বিগ ব্যাং’, এটা মানতে চাইলে বাদ সাঁধে ধর্মীয় মতবাদ। এক্ষেত্রে বিজ্ঞান বলে এককথা আর আর বিভিন্ন ধর্মে আছে নানা কথা।
মহাবিশ্বের সৃষ্টি রহস্য নিয়ে বৈজ্ঞানিক মতবাদ আর ধমীয় মতবাদগুলোর প্রতি চোখ রাখা যাক –
বিগব্যাং
মহাবিশ্ব সৃষ্টির আধুনিক বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব হলো বিগ ব্যাং । এই তত্ত্ব অনুসারে ১৫০০ কোটি বৎসর আগের কোন এক সময় একটি বিশাল বস্তুপিণ্ডের বিস্ফোরণের ফলে মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছিল। ১৯২৭ সালে বেলজিয়ামের বিজ্ঞানী জর্জ লেমিটর (Georges Lemaitre) এই তত্ত্ব প্রথম প্রকাশ করেন। তাঁর মতে সৃষ্টির আদিতে মহাবিশ্বের সকল বস্তু আন্তঃআকর্ষণে পুঞ্জীভূত হয় এবং একটি বৃহৎ পরমাণুতে পরিণত হয়। এই পরমাণুটি পরে বিস্ফোরিত হয়ে মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়। এই মতবাদকে সমর্থন ও ব্যাখ্যা করেন এডুইন হাবল (Edwin Hubble)। হাবল পর্যবেক্ষণ দ্বারা প্রমাণ পান যে— মহাকাশের গ্যালাক্সিগুলো পরস্পর থেকে ক্রমান্বয়ে নির্দিষ্ট গতিতে দূরে সরে যাচ্ছে। তাঁর মতে, আদিতে মহাবিস্ফোরণের ফলে গ্যালাক্সিগুলো সৃষ্টি হয়েছিল এবং এগুলোর দূরে সরে যাওয়ার আচরণ বিগ-ব্যাংকেই সমর্থন করে।
এই ভাবে বিস্ফোরণের ফলে যে বিকিরণের (radiation) সৃষ্টি হওয়ার কথা, তার অস্তিত্ব প্রথম দিকে প্রমাণ করা যায় নি। ফলে বিষয়টি নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব উপস্থিত হয়। ১৯৬৪ সালে Arno Penzias এবং Robert Wilson নামক দুজন বিজ্ঞানী বিকিরণের অস্তিত্ব প্রমাণ করেন। ফলে বিগব্যাং-এর ধারণা আরও সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। মহাবিশ্ব সৃষ্টির ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত এই তত্ত্বকেই সত্য বলে বিবেচনা করা হয়।
বিগব্যাং মতবাদ অনুসারে মহাবিশ্ব সৃষ্টি রহস্য
আদিতে মহাকাশের বস্তুপুঞ্জ বিক্ষিপ্তাকারে ছড়ানো ছিল। অবশ্য এই আদি বস্তুপুঞ্জ কিভাবে সৃষ্টি হয়েছিল এবং এগুলোর বিন্যাস কিরূপ ছিল, তার ব্যাখ্যা বিজ্ঞানীরা দিতে পারেন নি। বিগব্যাং তত্ত্ব অনুসারে— প্রায় ১৫০০ কোটি বৎসর আগে এই সকল বিক্ষিপ্ত বস্তুগুলো আন্ত-আকর্ষণের কারণে পরস্পরের কাছে আসতে থাকে এবং ধীরে ধীরে একটি ডিমের আকার ধারণ করে। বিজ্ঞানীরা একে নামকরণ করেছেন মহাপরমাণু (Supper Atom)। উল্লেখ্য এই সময় কোন স্থান ও কালের অস্তিত্ব ছিল না। অসীম ঘনত্বের এই মহাপরমাণুর ভিতরে বস্তুপুঞ্জের ঘন সন্নিবেশের ফলে এর তাপমাত্রা দাঁড়িয়েছিল- যে কোন পরিমাপ স্কেলের বিচারে ১০১৮ ডিগ্রী। বিগ ব্যাং-এর পরের ১ সেকেন্ডে যে ঘটনাগুলি ঘটেছিল, তা কালানুক্রমে নিচে তুলে ধরা হলো-
১ থেকে ১০-৪৩ সেকেণ্ড : কোয়ান্টাম সূত্রানুসারে বিগব্যাং-এর ১০-৪৩ সেকেন্ডের [এই সময়কে প্লাঙ্ক-অন্তঃযুগ (Planck epoch) বলা হয়] ভিতর চারটি প্রাকৃতিক বলের (force) সমন্বয় ঘটেছিল। এই বলগুলো হলো- সবল নিউক্লীয় বল, দুর্বল নিউক্লীয় বল, বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বল ও মহাকর্ষীয় বল। সবগুলো মিলে একটি অতি বৃহৎ বলের (super force) সৃষ্টি হয়েছিল।
প্লাঙ্ক-অন্তঃযুগ থেকে ১০-৩৫ সেকেণ্ড : প্লাঙ্কের সময় অতিবাহিত হওয়ার কিছু পরে মহাকর্ষীয় বল, অন্য তিনটি বল থেকে পৃথক হয়ে গিয়েছিল। ফলে মাধ্যাকর্ষণজনিত শক্তির কারণে, মহাপিণ্ডটি সর্বোচ্চ সংকোচন মাত্রায় পৌঁছেছিল। তখন ঘনত্বের বিচারে মহাপরমাণুর প্রতি ঘন সেন্টিমিটারে বস্তু ছিল ৫১০+৯৩ গ্রাম। এই সময় এর তাপমাত্রা ছিল ১০৩২ কেলভিন। ১০-৩৫ সেকেন্ড সময়ের মধ্যে এই তাপমাত্রা এসে দাঁড়িয়েছিল প্রায় ১০২৭ কেলভিন। এই সময় কোয়ার্ক ও লেপ্টন কণার সৃষ্টি হয়েছিল। একই সাথে তৈরি হয়েছিল— কিছু বস্তু এবং প্রতিবস্তুসমূহ (antiparticles)। পরে বস্তু ও তার প্রতিবস্তুর মধ্যে সংঘর্ষ হলে উভয় ধরনের বস্তুগুলো ধ্বংস হয়ে যায়। এর ফলে শুধু কোয়ার্ক ও লেপ্টন রয়ে যায়।
১০-৩৫ থেকে ১০-১০ সেকেণ্ড : পরবর্তী ১০-১০ সেকেন্ড সময়ের মধ্যে তাপমাত্রা নেমে আসে ১০১৬ কেলভিনে। এই তাপমাত্রা পরে আরও কমে গেলে দুর্বল নিউক্লীয় বল ও বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বল পৃথক হয়ে যায়। এই সময় কোয়ার্কসমূহ সবল বলের প্রভাবে আবদ্ধ হয়ে সৃষ্টি করে ফোটন, প্রোটন এবং নিউট্রন।
১ সেকেন্ড পরে : ১ সেকেন্ড পরে তাপমাত্রা নেমে আসে ১০১০ কেলভিনে। কিন্তু এই তাপমাত্রায় পরমাণু সৃষ্টি অসম্ভব ছিল।
ধারণা করা হয় বিগব্যাং-এর ৩ সেকেণ্ড থেকে ১০০,০০০ বৎসরের মধ্যে সৃষ্ট কণাগুলো শীতল হয়ে উঠে। এই অবস্থায় বস্তুপুঞ্জে বিরাজমান ইলেক্ট্রন, প্রোটন ও নিউট্রন মিলিত হয়ে তৈরি হয় হাইড্রোজন ও হিলিয়াম পরমাণু। এ ছাড়া এই দুটি পদার্থের সাথে ছিল প্রচুর ইলেক্ট্রন প্লাজমা। সব মিলিয়ে যে বিপুল বস্তুকণার সমাবেশ ঘটেছিল, সেগুলো প্রচণ্ড গতিতে বিগ ব্যাং-এর কেন্দ্র থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল। এই সময় এই সকল কণিকাও ছিল অত্যন্ত উত্তপ্ত। ক্রমে ক্রমে এগুলো শীতল হতে থাকলো এবং এদের ভিতরের আন্তঃআকর্ষণের কারণে- কাছাকাছি চলে এসেছিল। ফলে বিপুল পরিমাণ বস্তুপুঞ্জ পৃথক পৃথক দল গঠন করতে সক্ষম হয়েছিল। এই পৃথক দল গঠনের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পত্তন ঘটেছিল গ্যালাক্সি’র (Galaxy)। আমাদের সৌরজগতও এরূপ একটি গ্যালাক্সির ভিতরে অবস্থান করছে। এই গ্যালাক্সির নাম ছায়াপথ (Milky Way)।
এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড কে সৃষ্টি করেছেন? কেনই বা জগৎসৃষ্টি করেছেন? এসব প্রশ্ন সবার মনেই জাগ্রত হয়। জগৎস্রষ্টার সৃষ্টিরহস্য ভেদ করা মনুষের পক্ষে দুঃসাধ্য। তত্ত্বদ্রষ্টা ঋষিরা ধ্যানযোগে সৃষ্টিতত্ত্ব সম্পর্কে যা জানতে পেরেছেন তা শিষ্যদের নিকট ব্যক্ত করে গেছেন। শুরুতেই বৈদিক ঋষি কর্তৃক বর্ণিত সৃষ্টিতত্ত্ব প্রসঙ্গে আসা যাক।
সৃষ্টিতত্ত্ব
বেদে সৃষ্টিতত্ত্ব
ঋক্-বেদের ১০ম মণ্ডলের ৮২ নং সূক্তে আছে- ‘‘যিনি এসব সৃষ্টি করছেন তাকে তোমরা বুঝতে পার না। তোমাদের অন্তঃকরণ তা বোঝায় ক্ষমতা প্রাপ্ত হয়নি। কুজ্বটিকাতে আচ্ছন্ন হয়ে লোকে নানা প্রকার জল্পনা করে’’। ঋকবেদের ‘‘নাসদীয় সূক্তে’’ সৃষ্টিতত্ত্ব সম্পর্কে যে আলোচনা করা হয়েছে তা এরকম-‘‘সেকালে যা নেই তা ছিলনা, যা আছে তাও ছিলনা। পৃথবীও ছিল না, অতি দূরবিস্তার আকাশও ছিল না। আবরণ করে এমন কিছু ছিল না। কোথায় কার স্থান ছিল? দুগর্ম ও গম্ভীর জল কি তখন ছিল? তখন মৃত্যু ছিল না, অমরত্বও ছিল না। রাত্রি ও দিনের প্রভেদ ছিল না। কেবল সে একমাত্র বস্ত্ত বায়ুর সাহায্য ব্যতিরেকে আত্মা মাত্র অবলম্বনে নিশ্বাস-প্রশ্বাসযুক্ত হয়ে জীবিত ছিলেন। তিনি ব্যতীত আর কিছুই ছিল না। সর্বপ্রথমে অন্ধকারের দ্বারা অন্ধকার আবৃত ছিল। সমসত্মই চিহ্ন বর্জিত ও চতুর্দিক জলময় ছিল। অবিদ্যমান বস্তু দ্বারা সে সর্বব্যাপী আচ্ছন্ন ছিলেন। তপস্যার প্রভাবে সে এক বস্ত্ত জন্ম নিল। সর্বপ্রথমে মনের উপর কামের আবির্ভাব হল। তা হতে সর্বপ্রথম উৎপত্তির কারণ নির্গত হল। বুদ্ধিমানগণ বুদ্ধি দ্বারা আপন হৃদয়ে পর্যালোচনাপূর্বক অবিদ্যমান বস্ত্ততে বিদ্যমান বস্ত্ত উৎপত্তিস্থান নিরূপণ করলেন। রেতোধা পুরুষেরা উদ্ভব হলেন, মহিমা (পঞ্চভূত) সকল উদ্ভব হল। ওদের রশ্মি দু-পার্শ্বে ও নিম্নের দিকে এবং ঊর্ধদিকে বিস্তারিত হল, নিম্নদিকে স্বধা (নিকৃষ্ট অন্ন) থাকল, প্রযতি (ভোক্তা পুরুষ) ঊর্ধদিকে থাকলেন। কেই বা প্রকৃত জানে? কেই বা বর্ণনা করবে। কোথা হতে জন্মগ্রহণ করলে? কোথা হতে এসব নানা সৃষ্টি হল? দেবতারা এ সমস্ত নানাবিধ সৃষ্টির পর হয়েছেন, কোথা হতে যে হল তা কেই বা জানেন? এ নানাবিধ সৃষ্টি কোথা হতে হল? কার থেকে হল? কেউ সৃষ্টি করেছেন, কি করেননি, তা তিনিই জানেন। যিনি এর প্রভূ স্বরূপ পরমধামে আছেন অথবা তিনিও না জানতে পারেন।
ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলে পুরুষ সূক্তে আছে- ‘‘সহস্র মস্তক, চক্ষু ও চরণবিশিষ্ট এক পুরুষ। তিনি অমর। তার তিন পাদ আকাশে (অমর অংশ) এবং এক পাদ ব্যক্ত হয়ে বিশ্বজগৎ হয়েছে’’। ঋগ্বেদের ১০ম মণ্ডলের ৮২ নং সূক্তে আছে, ‘‘বিশ্বকর্মা এই বিশ্ব সৃষ্টি করেছেন। এই বিশ্বভূবন প্রথমে জলাকৃতি ছিল। পরে তিনি এ জলাকৃতিকে বিশ্বভূবনে পরিণত করলেন। যখন চতুঃসীমা ক্রমশ দূর হয়ে উঠল, তখন দ্যুলোক (স্বর্গ) ও ভূলোক (পৃথিবী) পৃথক হয়ে গেল।
উপনিষদে সৃষ্টিতত্ত্ব
ঐতয়ের উপনিষদে আছে, সৃষ্টির পূর্বে এই দৃশ্যমান জগৎ একমাত্র অদ্বিতীয় আত্মা স্বরূপেই বর্তমান ছিল। নিমেষাদি ক্রিয়াযুক্ত অপর কিছুই ছিল না। সেই আত্মা চিন্তা করলেন-আমি লোকসমূহ সৃষ্টি করব। তারপর তিনি ক্রমে ক্রমে অম্ভলোক (দ্যুলোকের উপরে অবস্থিত জললোক ধারণ করে) মরীচিলোক (আকাশ), মরলোক (পৃথিবী) ও অপলোক (নদী ও সমুদ্র) সৃষ্টি করলেন। তারপর তিনি লোকপাল সৃষ্টি করার চিন্তা করলেন। তখন তিনি জল থেকে পুরুষাকার পিণ্ডকে গ্রহণ করে সেই পিণ্ডকে উদ্দেশ্য করে সঙ্কল্প করলেন। সে সঙ্কল্পের ফলে পাখীর ডিমের মত মুখবিবর ফুটিয়ে বাহির হল। সে মুখ-গহবর থেকে বাক্-ইন্দ্রিয় এবং এর অধিদেবতা অগ্নি প্রকাশ পেলেন। অতঃপর নাসিকা থেকে ঘ্রাণেন্দ্রিয় এবং ঘাণেন্দ্রিয় থেকে এর অধিদেবতা বায়ু প্রকাশিত হলেন। ঘ্রাণেন্দ্রিয় সৃষ্টির পর ক্রমে ক্রমে দর্শন-ইন্দ্রিয় ও এর অধিদেবতা সূর্য, শ্রবণেন্দ্রিয় ও এর অধিদেবতা দিকসমূহ এবং স্পর্শেন্দ্রিয় ও এর অধিদেবতা বায়ু প্রকাশিত হলেন। এর পর হৃদপদ্ম প্রকাশিত হল। হৃদপদ্ম থেকে অন্তঃকরণ (মন, বুদ্ধি, অহংকার ও চিত্ত) এবং এর দেবতা চন্দ্র প্রকাশিত হলেন। চন্দ্র প্রকাশিত হওয়ার পর নাভি প্রকশিত হল। নাভি থেকে অপান (পায়ু ইন্দ্রিয়) এবং অপান হতে এর অধিদেবতা মৃত্যু অভিব্যক্ত হলেন। তারপর শিশ্ন (জননেন্দ্রিয়) বাহির হল। শিশ্ন থেকে রেতঃ (শুক্র সমন্বিত ইন্দ্রিয়) প্রকাশ পেল এবং রেতঃ থেকে এর অধিদেবতা প্রজাপতি প্রকটিত হলেন। ঈশ্বর পিণ্ডাকৃতির পুরুষে ক্ষুধা-তৃষ্ণা প্রবেশ করালেন। তখন ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর দেবগণ ঈশ্বরের নিকট অন্ন ভোজনের জন্য আশ্রয় প্রার্থনা করলেন। দেবতাদের কথা শুনে ঈশ্বর প্রথমে গরু আকৃতির পিণ্ড তৈরি করলেন কিন্তু তাতে দেবতারা সন্তুষ্ট হলেন না। তখন ঈশ্বর অশ্ব আকৃতির পিণ্ড তৈরি করলেন কিন্তু তাতেও দেবতারা সন্তুষ্ট হলেন না। তারপর ঈশ্বর পুরুষ আকৃতির এক পিণ্ড তৈরি করলে দেবতারা সন্তুষ্ট হলেন এবং তাঁর নির্দেশে স্ব স্ব স্থান অধিকার করলেন। ঐ পুরুষের দেহে ক্ষুধা-তৃষ্ণাকেও স্থান দেয়া হল। তারপর দেবতারা ক্ষুধা-তুষ্ণা নিবারণের জন্য অন্ন সৃষ্টি করলেন। সে পুরুষ অপান বায়ু দ্বারা অন্নগ্রহণ করতে সমর্থ হলেন। পরমেশ্বর ইন্দ্রিয়গণকে পরিচালনা করার জন্য মাথার কেশ বিভক্ত স্থান (মস্তকের মধ্যদেশ) বির্দীণ করে ব্রহ্মরন্ধ্র পথেই সে পুরম্নষে প্রবেশ করলেন, সেজন্য ঐ দ্বারকে বিদৃতি দ্বার বলে। পরমেশ্বরের প্রকাশ স্থান তিনটি, যথা- জাগ্রত অবস্থায় চক্ষু, স্বপ্নাবস্থায় মন এবং সুষুপ্তি অবস্থায় হৃদয়াকাশ।
ছান্দোগ্য উপনিষদে বর্ণিত আছে, এ জগৎ পূর্বে অসৎ (নাম ও রূপহীন) ছিল। সৃষ্টির সময় তা সৎ (সত্ত্বা-বিশিষ্ট) ও ডিম্বে পরিণত হল। এক বৎসর স্পন্দনহীন অবস্থায় থেকে সে ডিম্ব বিভক্ত হল। ডিম্বের একভাগ রজতময় (রৌপ্যময়) এবং অপরভাগ স্বর্ণময় হল। রজতময় অংশ থেকে পৃথিবী, সুবর্ণময় অংশ থেকে স্বর্গ, জরায়ু থেকে পর্বত সমূহ, উল্ব (সূক্ষ্মগর্ভ-বেষ্টন) থেকে মেঘ ও তুষার, ধমনী থেকে নদীসমূহ এবং বস্তি (মুত্রাশয় প্রদেশের জল) থেকে সমুদ্র সৃষ্টি হয়েছে। তারপর সূর্য সৃষ্টি হলে ‘উলু উলু’ ধ্বনিত হল। তৈত্তিরীয় উপনিষদে উল্লেখ আছে, ব্রহ্ম হতে আকাশ, আকাশ হতে বায়ু, বায়ু হতে অগ্নি, অগ্নি হতে জল, জল হতে পৃথিবী, পৃথিবী হতে ওষধিসমূহ (যেসব উদ্ভিদ একবার ফল দিয়ে মরে যায়), ওষধিসমূহ হতে অন্ন, অন্ন হতে বীর্য (শুক্র) এবং বীর্য হতে পুরুষের সৃষ্টি হয়েছে।
স্মৃতি-শাস্ত্রে সৃষ্টিতত্ত্ব
মনুসংহিতা মতে ব্রহ্মার মানস পুত্র দশজন, যথা- মরীচি, অত্রি, অঙ্গিরা, পুলস্ত্য, পুলহ, ক্রতু, প্রচেতা, বশিষ্ট, ভৃগু ও নারদ। এই দশজন মুনি যক্ষ (কুবেরের অনুচরগণ), রক্ষ (রাক্ষস), পিশাচ, গন্ধর্ব (নৃত্য ও গীতবিদ্যায় পারদর্শী দেবগণের অনুচর), কিন্নর (স্বর্গের গায়ক), অসুর, নাগ, সর্প, বানর, মৎস্য, পক্ষী, গরু-ছাগলাদি পশু, মৃগ, সিংহ, ব্যাঘ্র, কৃমি, কীট, পতঙ্গ, যূকা (উকুন), মক্ষিকা (মাছি), মৎকুণ (ছার-পোকা), মশক প্রভৃতি জীব সৃষ্টি করলেন। দশ মুনি কর্তৃক সৃষ্ট জীবদের চার ভাগে ভাগ করা যায়, যথা- জরায়ুজ), অণ্ডজ (অণ্ড বা ডিম থেকে যাদের জন্ম, যেমন- পক্ষী, সর্প, কুমীর, মৎস্য, কচ্ছপ প্রভৃতি), স্বেদজ (স্বেদ বা ঘাম থেকে যাদের জন্ম, যেমন- মশা, উকুন, মাছি, ছার-পোকা, দংশ বা ডাঁশ প্রভৃতি) এবং উদ্ভিজ্জ (মাটি ভেদ করে যা উপরে ওঠে, যেমন- লতা, গুল্ম, বীরুৎ, বৃক্ষ প্রভৃতি)।
পুরাণে সৃষ্টিতত্ত্ব
ব্রহ্মাণ্ড পুরাণে অষ্টবিধ সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে, যথা- মহৎ, পঞ্চভূত বা পঞ্চ-তন্মাত্র, ইন্দ্রিয়গণ, স্থাবর, তির্যকযোনি, ঊর্ধস্রোত, অর্বাকস্রোত ও অনুগ্রহ সৃষ্টি। এই অষ্টবিধ সৃষ্টির মধ্যে মহৎ, পঞ্চভূত ও ইন্দ্রিয়গণের সৃষ্টিকে প্রাকৃত-সৃষ্টি এবং স্থাবর, তির্যকযোনি, ঊর্ধস্রোত, অর্বাকস্রোত ও অনুগ্রহ এই পাঁচ প্রকার সৃষ্টিকে বৈকারিক সৃষ্টি বলে। স্থাবর সৃষ্টি বলতে বনষ্পতি, ওষধি, লতা, ত্বক্সার, বীরুৎ ও দ্রুম (বৃক্ষ) এই ছয় প্রকার উদ্ভিদ সৃষ্টিকে বোঝায়। সৃষ্টির শুরুতে যখন ব্রহ্মা ধ্যানস্থ হলেন, তখন তির্যকভাবে তীর্যকযোনি, অর্বাক বা পশ্চাৎ দিকে অর্বাকস্রোত এবং ঊর্ধভাবে ঊর্ধস্রোত সৃষ্টি হল। তমঃ প্রধান পশু-পক্ষীই তীর্যক স্রোত, সত্ত্ব-রজঃ-তমঃ গুণবিশিষ্ট মানবগণই হলেন অর্বাকস্রোত এবং দেবগণই হলেন ঊর্ধস্রোত। অনুগ্রহ সৃষ্টি বলতে দয়া, প্রসন্নতা প্রভৃতি সৃষ্টি বোঝায়।
প্রাকৃত ও বৈকারিক সৃষ্টি
ভাগবত, শিব, বিষ্ণু, ব্রহ্ম প্রভৃতি বিভিন্ন পুরাণে সৃষ্টিতত্ত্বের বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। সৃষ্টির আদিতে ঈশ্বর পুরুষ এবং প্রকৃতিতে বিভক্ত হন। প্রকৃতি সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ এই তিন গুণবিশিষ্ট। সৃষ্টির পূর্বে সত্ত্ব, রজঃ ও তমোগুণ সাম্যাবস্থায় থাকে। সৃষ্টির সময় রজোগুণের এবং প্রলয়ের সময় তমোগুণের আধিক্য ঘটে। সৃষ্টির আদিতে ঈশ্বর প্রথমে মহতত্ত্ব বা বুদ্ধিতত্ত্ব সৃষ্টি করলেন। মহতত্ত্বের সাথে তিনি ত্রিগুণ মিশিয়ে তাতে দ্রব্য, ক্রিয়া ও জ্ঞান সংযোজন করে অহংকার-তত্ত্ব সৃষ্টি করলেন। অহংকার তিন প্রকার, যথা- সাত্ত্বিক, রাজসিক এবং তামসিক। সাত্ত্বিক অহংকার হতে দিক, বায়ু, অর্ক (সূর্য), চন্দ্র, অশ্বিনীকুমার, বহ্নি (অগ্নি), ইন্দ্র, উপেন্দ্র (বিষ্ণু), মিত্র ও প্রজাপতি এই দশ দেবতা সৃষ্টি হল। এই দশ জন দেবতা মূলত দশ ইন্দ্রিয়ের অধিপতি। রাজসিক অহংকার হতে জ্ঞানশক্তি, ক্রিয়াশক্তি, দশ ইন্দ্রিয় এবং মন সৃষ্টি হল। দশ ইন্দ্রয়ের মধ্যে চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহবা ও ত্বক এই পাঁচ ইন্দ্রিয়কে জ্ঞানেন্দ্রিয় এবং বাক্ (মুখ), পাণি (হাত), পাদ, পায়ু (মলদ্বার) ও উপস্থ (জননেন্দ্রিয়) এই পাঁচ ইন্দ্রিয়কে কর্মেন্দ্রিয় বলে। চক্ষুর কর্ম দর্শন, কর্ণের কর্ম শ্রবণ, নাসিকার কর্ম আঘ্রাণ, জিহবার কর্ম আস্বাদন এবং ত্বকের কর্ম স্পর্শন। বাক্-ইন্দ্রিয়ের কর্ম বচন বা বাক্য কখন, পাণির কর্ম শিল্প, পাদের কর্ম গমন, পায়ুর কর্ম বিসর্গ বা ত্যাগ এবং উপস্থের কর্ম রমণ বা আনন্দ উপভোগ। চক্ষুর দেবতা সূর্য, কর্ণের দেবতা দিক, নাসিকার দেবতা অশ্বিনীকুমার, জিহ্বার দেবতা বরুণ, ত্বকের দেবতা বায়ু, বাকের দেবতা অগ্নি, পাণির দেবতা ইন্দ্র, পাদের দেবতা উপেন্দ্র, পায়ুর দেবতা যম, এবং উপস্থের দেবতা প্রজাপতি। মন, বুদ্ধি, অহংকার ও চিত্তকে অন্তঃকরণ বলে। মনের দেবতা চন্দ্র, বুদ্ধির দেবতা চতুর্মুখ (ব্রহ্মা), অহংকারের দেবতা শঙ্কর (শিব) এবং চিত্তের দেবতা অচ্যুত (বিষ্ণু)। তামসিক অহংকার হতে ক্ষিতি (মাটি), অপ (জল), তেজঃ (আগুন), মরুৎ (বায়ু) এবং ব্যোম (আকাশ) এই পঞ্চভূত এবং এদের গুণ পঞ্চ-তন্মাত্র (শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস এবং গন্ধ) সৃষ্টি হল। শব্দ, স্পর্শ, রূপ এবং রস এই চারটি জলের গুণ। শব্দ, স্পর্শ ও রূপ এই তিনটি আগুনের গুণ। শব্দ ও স্পর্শ এই দুটি বায়ুর গুণ। আকাশের গুণ শব্দ এবং মাটির গুণ গন্ধ। তামসিক অহংকার বিকারপ্রাপ্ত বা পরিবর্তিত হয়ে প্রথমে শব্দ তন্মাত্র উৎপন্ন হয়েছে। সে শব্দ তন্মাত্র থেকে শূন্যময় আকাশের সৃষ্টি হয়েছে। আকাশ বিকারপ্রাপ্ত হয়ে স্পর্শ তন্মাত্র সৃষ্টি হয়েছে এবং তা থেকে বায়ু সৃষ্টি হয়েছে। বায়ু বিকারপ্রাপ্ত হয়ে রূপ তন্মাত্র সৃষ্টি হয়েছে, যা থেকে অগ্নি সৃষ্টি হয়েছে। অগ্নি বিকারপ্রাপ্ত হয়ে রস তন্মাত্র সৃষ্টি হয়েছে এবং রস তন্মাত্র থেকে জল উৎপন্ন হয়েছে। জল বিকারপ্রাপ্ত হয়ে গন্ধ তন্মাত্র সৃষ্টি হয়েছে এবং তা থেকে পৃথিবী বা মাটি সৃষ্টি হয়েছে। মহতত্ত্ব থেকে মহাভূত পর্যন্ত সকল বস্ত্ত নানা শক্তি সম্পন্ন এবং পৃথক পৃথক ভূত বলে এরা সম্পূর্ণ মিলিত হতে পারল না। পৃথকভাবে নিজেদের মধ্যে মিলিত হতে না পারায় এরা প্রজা সৃষ্টি করতে অক্ষম হল। ফলে মহতত্ত্ব হতে পঞ্চ-মহাভূত পর্যন্ত সকল বস্তু মিলিত হয়ে একটি হিরণ্যময় (সোনালী) অণ্ড বা ডিম্বে পরিণত হল। সেই হিরণ্যময় অণ্ডের মধ্যে ব্রহ্মা অবস্থান করলেন। এজন্য ব্রহ্মাকে হিরণ্যগর্ভ বলা হয়। সেই হিরণ্যময় অণ্ড থেকেই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি হয়েছে। অণ্ডের উপরিভাগ থেকে ভূঃ, ভূবঃ, স্বঃ আদি সপ্তলোক এবং নিম্নভাগ থেকে অতল, বিতল আদি সপ্ত-পাতাল সৃষ্টি হয়েছে। তারপর ব্রহ্মা ক্রমে ক্রমে দশ দিক, কাল, মন, বাক্য, কাম, ক্রোধ ও রতি সৃষ্টি করলেন। ব্রহ্মা প্রজা সৃষ্টির জন্য নিজ মানস হতে মরীচি, অত্রি, অঙ্গিরা, পুলস্ত্য, পুলহ, ক্রতু এবং বশিষ্ঠ এই সপ্তঋষি সৃষ্টি করলেন। এদেরকে ব্রহ্মার মানসপুত্রও বলা হয। সপ্তঋষি ছাড়াও ব্রহ্মা সনৎকুমার আদি চার জন কুমার সৃষ্টি করলেন। তারপর ব্রহ্মা বিদুৎ, অশনি (অগ্নি), মেঘ, ইন্দ্রধনু, পক্ষীগণ ও পর্জন্য সৃষ্টি করলেন এবং তিনি যজ্ঞকার্য সম্পাদন করা জন্য বেদ সৃষ্টি করলন।
পুরাণে একথাও আছে যে, ব্রহ্মার মানসপুত্রগণ এবং সনকাদি কুমারগণ প্রজা বৃদ্ধি করতে পারছে না দেখে ব্রহ্মা নিজ দেহকে দ্বিখণ্ডিত করলেন। দেহের এক খণ্ড থেকে মনু নামক পুরুষ এবং অপর খণ্ড থেকে শতরূপা নামক প্রকৃতি (নারী) জন্ম নিলেন। এই মনু ও শতরূপা থেকে প্রজাবৃদ্ধি হতে লাগল। ব্রহ্মার দেহ থেকে উৎপন্ন বলে মনুকে স্বায়ম্ভুব বলা হয়। সায়ম্ভুব মনুর ঔরসে এবং শতরূপার গর্ভে বীর, প্রিয়ব্রত ও উত্তানপাদ নামক নামক তিনটি পুত্রের জন্ম হয়। উত্তানপাদ ধর্মের কন্যা সুনীতিকে বিবাহ করেন। সুনীতির গর্ভে ধ্রুব, কীর্তিমান, আয়ুষ্মান ও বসু নামক চার পুত্রের জন্ম হয়। ধ্রুব থেকে শিষ্টি, ভব্য ও শম্ভু নামক তিন পুত্র উৎপন্ন হয়। শিষ্টির সুচ্ছায়া নামক পত্নীর গর্ভে রিপু, রিপুঞ্জয়, বৃকল, বিপ্র ও বৃকতেজা এই পঞ্চপুত্র জন্মগ্রহণ করেন। রিপুর পুত্র চাক্ষুষের ঔরসে ও পুষ্করিণীর গর্ভে বরুণের জন্ম হয়। চাক্ষুষ মনুর ঔরসে কুৎস, পুরু, শতদ্যুম্ন, তপস্বী, সত্যবাক্, কবি, অগ্নিষ্টোম, অতিরাত্র, সুদ্যুম্ন এবং অভিমন্যু এই দশ-পুত্র জন্মলাভ করে। পুরম্ন হতে আগ্নেয়ীয় গর্ভে যে ছয়টি মহাতেজা পুত্র জন্মগ্রহণ করেন, তাঁদের নাম- অঙ্গ, সুমনস, খ্যাতি, ক্রতু, আঙ্গিরস ও গয়।
অঙ্গপত্নী সুনীথার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন বেণ। বেন রাজা ছিলেন পাপী ও অত্যাচারী। তাই মুনিগণ তাঁদের দক্ষিণ হস্ত মন্থন করে পৃথু নামক এক পুত্র সৃষ্টি করলেন। পৃথু গোরূপিণী পৃথিবীকে দোহন করে শস্যরাশি উৎপাদন করে প্রজাপালন করতে লাগলেন। পৃথুকেই বলা হয় পৃথিবীর প্রথম রাজা এবং পৃথু থেকে ‘‘পৃথিবী’’ শব্দ উৎপন্ন হয়। পৃথুর রাজত্বকালে সূত ও মগধ জাতির উৎপত্তি হয়। পৃথু রাজার অমত্মর্দ্ধি ও পাতি নামক দুই পুত্রের জন্ম হয়। অমত্মর্দ্ধির ঔরসে শিখণ্ডিনীর গর্ভে হবির্দ্ধান নামক এক পুত্র জন্মলাভ করেন। হবির্দ্ধানের প্রাচীন-বহিঃ, শুক্ল, গয়, কৃষ্ণ, ব্রজ ও অজিন নামক ছয়পুত্র উৎপন্ন হয়। প্রাচীন-বহিঃ হতে সমুদ্রকন্যা সবর্ণার গর্ভে যে দশ পুত্রের জন্ম হয়েছিল তাঁরা প্রচেতা নামে খ্যাত হলেন। সেই প্রচেতাগণের অর্ধতেজে এবং সোমের অর্ধতেজঃ বৃক্ষনন্দিনী মারিষার গর্ভে দক্ষ প্রজাপতির জন্ম হয়। দক্ষ প্রজাপতি স্থাবর, জঙ্গম, দ্বিপদ, চতুষ্পদ প্রভৃতি জীব সৃষ্টি করলেন। দক্ষের ঔরসে যে পঞ্চাশ জন কন্যার জন্ম হয়, তার মধ্যে তিনি ধর্মকে দশ জন কন্যা, কশ্যপকে ত্রয়োদশ জন কন্যা এবং সোমকে (চন্দ্র) অবশিষ্ট সাতাশ জন কন্যা দান করলেন। সেই দক্ষ-কন্যাগণ থেকে দেবতা, দানব, গো, যগ, নাগ, গন্ধর্ব, অপ্সরা প্রভৃতি জাতির উৎপত্তি হয়েছিল। দক্ষের যে দশ কন্যা ধর্মের পত্নী হয়েছিলেন তাঁরা হলেন- অরুন্ধতী, বসু, যামী, লম্বা, ভানু, মরুত্বতী, সঙ্কল্পা, মুহূর্তা, সাধ্যা, এবং বিশ্বা। বিশ্বার গর্ভে বিশ্বদেবগণ, সাধ্যার গর্ভে সাধ্য দেবতাগণ, মরুত্বতীর গর্ভে মরুত্বানগণ, ভানুর গর্ভে ভানু বা আদিত্যগণ, মুর্হূতার গর্ভে মুহূর্ত, অরুন্ধতীর গর্ভে পৃথিবী, সঙ্কল্পার গর্ভে সর্বাত্মা-সঙ্কল্প, যামীর গর্ভে নাগবীথী, বসুর গর্ভে অষ্টবসু এবং লম্বার গর্ভে ঘোষ নামক পুত্রগণের জন্ম হয়। দক্ষ যে সাতাশ জন কন্যা চন্দ্রকে দান করেছিলেন তাঁরা মূলত সাতাশ নক্ষত্র।
কশ্যপকে দান করা দক্ষে ত্রয়োদশ কন্যা নাম- অদিতি, দিতি, দনু, অরিষ্টা, সুরসা, খসা, সুরভি, বিনতা, তাম্রা, ক্রোধবশা, ইলা, কদ্রু ও মুনি। কাশ্যপের ঔরসে দক্ষকন্যা অদিতির গর্ভে বিষ্ণু, শক্র, অর্যমা, ধাতা, বিধাতা, ত্বষ্টা, পূষা, বিবস্বান, সবিতা, মিত্রাবরুণ, অংশ ও ভগ এই দ্বাদশ আদিত্যের জন্ম হয়। দিতির গর্ভে হিরণ্যকশিপু ও হিরণ্যাক্ষ নামক দুই দৈত্য এবং সিংহিকা নামক এক রাক্ষসীর জন্ম হয়। হিরণ্যকশিপুর চার পুত্র, যথা- হ্রাদ, অনুহ্রাদ, প্রহ্লাদ ও সংহ্রাদ। হিরণ্যাক্ষের পাঁচ পুত্র, যথা- উর্জর, শকুনি, ভূতসমত্মাপন, মহানাভ ও কালনাভ। দনুর শতপুত্রের মধ্যে দ্বিমুর্দ্ধা, শুঙ্কুকর্ণ, হয়শিরা, অয়োমুখ, শম্বর, কপিল, বামন, মারীচি, মেঘবান, ইল্বল, খসৃম, বিক্ষোভন, কেতু, কেতুবীর্য, শতহ্রদ, ইন্দ্রিজিৎ, সর্বজিৎ, বজ্রনাভ, একচক্র, তারক, বৈশ্বানর, পুলোমা, বিদ্রাবণ, মহাসুর, স্বর্ভানু, বৃষপর্বা ও বিপ্রচিত্তি প্রধান। এরা সকলে মহাবল সম্পন্ন দানব। তাম্রার গর্ভে ক্রৌঞ্চা, শ্যেনী, ভাসী, সুগ্রীবী, শুচি, ও গৃধী নামক ছয় কন্যার জন্ম হয়। কশ্যপের ঔরসে বিনতার গর্ভে অরুণ ও গরুড় নামক দুই পক্ষীর জন্ম হয়। সুরসার গর্ভে সহস্র সর্পের এবং কদ্রুর গর্ভে অনন্ত, বাসুকি, তক্ষক, শঙ্খ, কর্কোটক, ধনঞ্জয়, বলাহক আদি সহস্র নাগের জন্ম হয়। সুরভির সন্তান গো ও মহিষী সকল এবং ইলার সমত্মান বিবিধ বৃক্ষ, লতা, বলস্নী ও তৃণজাতি। খসার গর্ভে যক্ষ ও রক্ষগণের, মুনির গর্ভে অপ্সরাগণের এবং অরিষ্টার গর্ভে গন্ধর্বগণের জন্ম হয়। ক্রোধবশা বা ধরার গর্ভে অসংখ্য জলপক্ষীগণের জন্ম হয়।
ষড়-দর্শনে সৃষ্টিতত্ত্ব
বিভিন্ন পুরাণশাস্ত্রও সাংখ্য-দর্শনের সৃষ্টিতত্ত্বকে স্বীকার করেছে। প্রকৃতি ও পুরুষের সংযোগে জগৎ সৃষ্টি হয়। প্রকৃতি জড়, সগুণা, পরিণামী এবং ক্রিয়াশীল কিন্তু পুরম্নষ নির্গুণ, চৈতন্যময়, অপরিণামী এবং নিষ্কৃয়। প্রকৃতির তিনগুণ, যথা- সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ। এই সত্ত্বগুণ জ্ঞান প্রকাশক। রজোগুণ গতিশীল এবং উত্তেজক। রজোগুণ নিজে গতিশীল এবং অন্যকেও গতিশীল করে। তমোগুণ আবরক, জড় এবং অসার। তমোগুণ কোন বস্তুতে আলস্য, জড়ত্ব এবং অজ্ঞানতা সৃষ্টি করে। সত্ত্বগুণ সুখ সরূপ, রজোগুণ দুঃখ স্বরূপ এবং তমোগুণ মোহ স্বরূপ। এই তিনগুণের সাম্যাবস্থাই প্রকৃতি। প্রকৃতির রজোগুণ ক্রিয়াশীল হলে সৃষ্টিকার্য শুরু হয়। পুরুষ ও প্রকৃতির সংযোগ ঘটলে রজোগুণের মধ্যে বিক্ষোভ বা আলোড়ন শুরম্ন হয়। রজোগুণ আলোড়িত হওয়ার পর সত্ত্ব ও তমোগুণকেও আলোড়িত করে। ফলে এই গুণগুলোর বিভিন্ন পরিমাণে সংযোগ ঘটতে থাকে এবং জাগতিক বস্তু সৃষ্টি হতে থাকে। প্রকৃতি থেকে প্রথমে মহৎ-তত্ত্ব, পরে মহৎ-তত্ত্ব থেকে অহঙ্কার-তত্ত্ব, অহঙ্কার-তত্ত্ব থেকে পঞ্চ-জ্ঞানেন্দ্রিয় (মাটি, জল, আগুন, বায়ু ও আকাশ), পঞ্চ-কর্মেন্দ্রিয় (হস্ত, মুখ, পদ, পায়ু ও জননেন্দ্রিয়), মন ও পঞ্চ-তন্মাত্র (পঞ্চভূতের গুণ) উৎপত্তি হয়। পঞ্চ-তন্মাত্র (শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস ও গন্ধ) থেকে পঞ্চভূত সৃষ্টি হয়। সাংখ্য মতে পঞ্চ-জ্ঞানেন্দ্রিয় এবং পঞ্চ-কর্মেন্দ্রিয় এই দশ ইন্দ্রিয়কে বাহ্যকরণ বলে এবং মন, বুদ্ধি, অহংকার, চিত্ত তিনটিকে অন্তঃকরণ বলে। সাংখ্য মতে প্রকৃতি, পঞ্চ-মহাভূত, ত্রয়োদশ-করণ (দশটি বাহ্যকরণ ও তিনটি অন্তঃকরণ) এবং পঞ্চ-তন্মাত্র এই চতুর্বিংশতি তত্ত্ব থেকে জগৎ সৃষ্টি হয়েছে।
বৈশেষিক দর্শনমতে পৃথিবী (মাটি), জল, অগ্নি ও বায়ু এই চারটি পরমাণুর সংযোগে জগৎ সৃষ্টি হয়েছে। দুটি পরমাণু মিলিত হয়ে দ্ব্যণুক এবং তিনটি পরমাণু মিলিত হয়ে ত্র্যণুক বা ত্রসরেণু গঠিত হয়। বায়ু পরমাণুগুলো কম্পিত ও গতিশীল হয়ে প্রথমে দ্ব্যণুক ও ত্র্যণুক গঠন করে। পরে এই দ্ব্যণুক ও ত্র্যণুকের সংযোগেই বায়ু মহাভূত উৎপন্ন হয়। একইভাবে জল, অগ্নি ও পৃথিবী মহাভূত উৎপন্ন হয়। এই পরমাণুর কম্পন ও সংযোগ ঘটায় ঈশ্বর। অর্থাৎ ঈশ্বরের ইচ্ছায় পরমাণুর কম্পনে অণু এবং অণু থেকে সকল যোগিক পদার্থ উৎপন্ন হয়।
বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ মতে জগৎ ঈশ্বরের দেহ স্বরূপ। অর্থাৎ জগৎ ঈশ্বর থেকে বিচ্ছিন্ন নয় আবার জগৎ ঈশ্বরও নয়। ঈশ্বরের অচিৎ বা জড় অংশ বিকারপ্রাপ্ত হয়ে জগতে পরিণত হয়েছে। তবে অদ্বৈতবেদামত্ম মতে কোন কিছুই সৃষ্টি হয়নি। ঈশ্বর অজর, অমর, অবিনাশী এবং অপরিণামী। কোন কিছু সৃষ্টি করতে জড় উপাদান প্রয়োজন। ঈশ্বর যেহেতু অজড় তাই ঈশ্বরের কোন জড় উপাদান থাকতে পারে না, ফলে ঈশ্বর কতৃর্ক কোন কিছু সৃষ্টিও অসম্ভব। তাছাড়া ঈশ্বর থেকে কোন কিছু সৃষ্টি হতে গেলে তাঁর বিকার বা পরিণাম ঘটতে হবে। ঈশ্বর যেহেতু বিকারশীল বা পরিণামী নয়, সেহেতু ঈশ্বর কর্তৃক কোন কিছু সৃষ্টি হতে পারে না। বস্ত্তত যা কিছুই সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে হচ্ছে, তা সত্য নয় অর্থাৎ তা ভ্রম বা মায়া। মায়ার কারণেই সকলে ঈশ্বরকে জগৎ মনে করছে।
কাল ও কল্প সৃষ্টি
চোখের পাতা পড়তে যে সময় লাগে তাকে নিমেষ বলে। পনের নিমেষে এক কাষ্ঠা, ত্রিশ কাষ্ঠায় এক কলা, ত্রিশ কলায় এক মূহূর্ত, ত্রিশ মুহূর্তে এক দিবারাত্রি হয়। সাত দিনে এক সপ্তাহ, পনের দিনে এক পক্ষ এবং ত্রিশ দিনে এক মাস হয়। তিনশত-পয়ষট্টি দিনে বা বার মাসে এক বৎসর হয়। পক্ষ দুটি, যথা- কৃষ্ণপক্ষ ও শুক্লপক্ষ। শুক্লপক্ষে পিতৃলোকের দিন এবং কৃষ্ণপক্ষে পিতৃলোকের রাত হয়। এক বৎসরে দুটি অয়ন, যথা- দক্ষিণায়ণ ও উত্তরায়ণ। পৌষ মাসের উত্থান একাদশী থেকে আষাঢ় মাসের শয়ান একাদশী পর্যন্ত এই ছয় মাস উত্তরায়ণ এবং অবশিষ্ট ছয় মাস দক্ষিণায়ণ। উত্তরায়ণে সূর্য উত্তরদিকে এবং দক্ষিণায়ণে সূর্য দক্ষিণদিকে গমন করেন। উত্তরায়ণের ছয় মাসে দেবতাদের এক দিন এবং দক্ষিণায়ণের ছয় মাসে দেবতাদের এক রাত হয়। উত্তরায়ণে দেবতারা জাগ্রত থাকেন এবং দক্ষিণায়ণে দেবতারা নিদ্রা যান। অতএব মর্ত্যলোকের এক বৎসরে দেবতাদের এক দিন (দিবারাত্র) এবং তিনশত ষাট বৎসরে দেবতাদের এক বৎসর হয়। সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলি এই চার প্রকার যুগ রয়েছে। সত্য যুগের আয়ু ৪,৮০০ দৈববৎসর বা মনুষ্যলোকের ১৭,২৮,০০০ বৎসর। চারশত দৈববৎসরে সত্য যুগের সন্ধ্যা হয় এবং চারশত দৈববৎসরে সত্য যুগের সন্ধ্যাংশ হয়। ত্রেতা যুগের আয়ু ৩৬০০ দৈববৎসর বা মনুষ্যলোকের ১২,৯৬,০০০ বৎসর। তিনশত দৈববৎসরে ত্রেতা যুগের সন্ধ্যা এবং তিনশত দৈববৎসরে ত্রেতা যুগের সন্ধ্যাংশ হয়। দ্বাপর যুগের পরিমান ২৪০০ দৈববৎসর বা মনুষ্যলোকের ৮,৬৪,০০০ বৎসর। দুইশত দৈববৎসরে দ্বাপরযুগের সন্ধ্যা এবং দুইশত দৈববৎসরে দ্বাপর যুগের সন্ধ্যাংশ হয়। কলি যুগের আয়ু ১২০০ দৈববৎসর বা মুনুষ্যলোকের ৪,৩২,০০০ বৎসর। একশত দৈব বৎসরে কলিযুগের সন্ধ্যা এবং একশত দৈববৎসরে কলিযুগের সন্ধ্যাংশ হয়। চার যুগের মোট পরিমান বার হাজার দৈববৎসর এবং এই বার হাজার দৈববৎসরে দেবতাদের এক যু্গ হয়। দেবতাদের এক হাজার যুগে অর্থাৎ পৃথিবীর ৪,৩২,০০,০০,০০০ বৎসরে ব্রহ্মার একদিন এবং সম সংখ্যক বৎসরে ব্রহ্মার এক রাত হয়। ব্রহ্মার দিনে ব্রহ্মা- সৃষ্টি হয় এবং রাতে তা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। সাত দৈবযুগে অর্থাৎ আটলক্ষ বাহান্ন দৈববৎসরে বা মানুষের হিসেবে ত্রিশকোটি সাতষট্টিলক্ষ কুড়িহাজার বৎসরে এক মন্বন্তর হয়। চতুর্দশ মন্বন্তরে হয় এক কল্প। সহজ কথায় ব্রহ্মার দিনকেই কল্প বলে।
মন্বন্তর সৃষ্টি
চতুর্দশ মন্বন্তরে যে চতুর্দশ জন মনু প্রজাপালন করেন, তাঁরা হলেন- স্বায়ম্ভুব, স্বরোচিষ, উত্তম, তামস, রৈবত, চাক্ষুষ, বৈবস্বত (সত্যব্রত), সাবর্ণি, দক্ষসাবর্ণি, ধর্মসাবর্ণি, রুদ্রসাবর্ণি, দেবতাসাবর্ণি এবং ইন্দ্রসাবর্ণি। স্বয়ম্ভুব মনু হলেন প্রথম মনু। স্বয়ং ব্রহ্মা নিজেকে দ্বিধা বিভক্ত করে স্বয়ম্ভুব মনু ও শতরূপাকে সৃষ্টি করেছেন। ভগবত মতে স্বয়ম্ভুব মনুর ঔরসে এবং শতরূপার গর্ভে প্রিয়ব্রত ও উত্তানপাদ নামক দুই পুত্রের এবং আকূতি, দেবাহূতি, ও প্রসূতি নামক তিন কন্যার জন্ম হয়। দ্বিতীয় মনু স্বরোচিষ হলেন অগ্নির পুত্র। তাঁর দুই পুত্রের নাম সুষেণ ও রোচিষ্মৎ। এই মন্বন্তরে তুষিতাদি দেবতা, রোচন নামক ইন্দ্র এবং ঊর্ধ, স্তম্ভাদি সপ্তর্ষি ছিলেন। তৃতীয় মনু উত্তম হলেন প্রিয়ব্রতের পুত্র। উত্তমের পুত্রগণের নাম- পবন, সৃঞ্জয় এবং যজ্ঞহোত্রাদি। এই মন্বন্তরে সত্য, বেদশ্রুত, ভদ্র প্রভৃতি দেবতা, সত্যজিৎ নামক ইন্দ্র এবং প্রমদ আদি সম্পর্ষি ছিলেন। চতুর্থ মনু তামস হলেন উত্তমের ভ্রাতা। তামসের পৃথু, খ্যাতি, নর, কেতু প্রভৃতি পুত্র ছিল। এই মনুর সময়ে সত্যক, হরি ও বীর নামক দেবতা, ত্রিশিখ নামক ইন্দ্র এবং জ্যোতির্ধামাদি সপ্তর্ষি ছিলেন। পঞ্চম মনু রৈবত হলেন তামসের ভ্রাতা। রৈবতের পুত্রগণের নাম অর্জুন, বলি ও বিন্ধ্যাদি। এই মন্বন্তরে ভূতরয়াদি দেবতা, বিভু নামক ইন্দ্র এবং হিরণ্যরোমা, বেদশিরা, ঊর্ধবাহু প্রভৃতি ব্রাহ্মণগণ ছিলেন। ষষ্ঠ মনু চাক্ষুষ হলেন চক্ষুষের পুত্র। তাঁর পুত্রগণের নাম পুরু, পুরুষ, সুদ্যুমণ প্রভৃতি। এই মনুর সময়ে আপ্যাদিগণ দেবতা, মন্ত্রদ্রুম নামক ইন্দ্র এবং হর্যস্মৎ ও কীরকাদি সপ্তর্ষি ছিলেন। বিবস্বানের পুত্র বৈবস্বত হলেন সপ্তম মনু। বৈবস্বতের দশটি পুত্র, যথা- ইক্ষ্বাকু, নভাগ, ধৃষ্ট, শর্যাতি, নরিষ্যস্ত, নাভাগ, দিষ্ট, করুষ, পৃষধ্র এবং বসুমান্। এই মন্বমন্তরে আদিত্য, বসু, রুদ্র, বিশ্বদেবগণ, মরুদগণ, অশ্বিনীকুমার, ঋভু প্রভৃতি দেবতা, পুরন্দর নামক ইন্দ্র এবং কশ্যপ, অত্রি, বশিষ্ঠ, বিশ্বামিত্র, গোতম, জমদগ্নি এবং ভরদ্বাজ এই সপ্ত ঋষি রয়েছেন। অষ্টম মনু সাবর্ণির ঔরসে নির্মোক এবং বিরজস্ক নামক পুত্রদ্বয়ের জন্ম হবে। এই মনুর সময়ে সুতপা, বিরজা আনৃতপ্রভা প্রভৃতি দেবতা, বিরোচনপুত্র বলি নামক ইন্দ্র এবং গালব, দীপ্তিমান, পরশুরাম, অশ্বত্থামা, কৃপ, ঋষ্যশৃঙ্গ এবং বদরায়ণ নামক সপ্তর্ষি থাকবে। নবম মনু বরুণপুত্র দক্ষসাবর্ণি ভূতকেতু, দীপ্তকেতু প্রভৃতি পুত্রলাভ করবেন। ঐ মন্বন্তরে মরীচি, গর্ভ প্রভৃতি দেবতা, অদ্ভূত নামক ইন্দ্র এবং দ্যুতিমান প্রভৃতি সপ্তর্ষি থাকবে। দশম মনু ব্রহ্মসাবর্ণি উপশ্লোকের পুত্র রূপে জন্ম নেবেন। তাঁর ভূরিষেণ আদি পুত্র থাকবে। ঐ মনুর সময় সুবাসন, অবিরুদ্ধাদি দেবতা, শম্ভু নামক ইন্দ্র এবং হবিষ্মান, সুকৃত্য, সত্য, জয়, মূর্তি প্রভৃতি সপ্তর্ষি থাকবে। একাদশ মনু ধর্মসাবর্ণির সত্য, ধর্ম আদি দশপুত্র থাকবে। ঐ মন্বন্তরে বিহঙ্গম, কালগণ ও রূচি প্রভৃতি দেবতা, বৈধৃত নামক ইন্দ্র এবং অরুণাদি সপ্তর্ষি থাকবে। দ্বাদশ মনু রুদ্রসাবর্ণির ঔরসে দেবযান, উপদেব প্রভৃতি পুত্রের জন্ম হনে। ঐ মন্বমন্তরে হরিতাদি দেবতা, গন্ধধামা নামক ইন্দ্র এবং তপোমূর্তি, তপস্বী, অগ্নীধ্র প্রভৃতি সপ্তর্ষি থাকবে। দেবসাবর্ণি ত্রয়োদশ মনু হবেন এবং তাঁর চিত্রসেন, বিচিত্র প্রভৃতি পুত্র থাকবে। ঐ মন্বন্তরে সুকর্মা, সুত্রামাদি দেবতা, দিবস্পতি নামক ইন্দ্র এবং নির্মোক, তত্ত্বদর্শ প্রভৃতি সপ্তর্ষি থাকবে। সর্বশেষ অর্থাৎ চতুর্দশ মনু ইন্দ্রসাবর্ণি ঊরু, গম্ভীর, ব্রধণ আদি পুত্র উৎপন্ন করবেন। ঐ মন্বন্তরে চাক্ষুষ প্রভৃতি দেবতা, শুচি নামক ইন্দ্র এবং অগ্নিবাহু, শুদ্ধ, মাগধ প্রভৃতি সপ্তর্ষি থাকবে। বর্তমান কল্পের নাম বারাহ কল্প এবং এই কল্পে সপ্তম মনু বৈবস্বতের শাসন চলছে।
সপ্তদ্বীপ ও বর্ষ সৃষ্টি
ব্রহ্মা পৃথিবীতে সাতটি দ্বীপ সৃষ্টি করেছেন, যথা- জম্বু, প্রক্ষ, শাল্মল, কুশ, ক্রৌঞ্চ, শাক ও পুষ্কর এবং এই সপ্তদ্বীপ যথাক্রমে লবণ, ইক্ষু, সুরা, ঘৃত, দধি, দুগ্ধ এবং জল এই সপ্তসমুদ্র দ্বারা পরিবেষ্টিত। সপ্তদ্বীপের মধ্যভাগে জম্বুদ্বীপ অবস্থিত। জম্বুদ্বীপের মধ্যভাগে চুরাশী-সহস্র যোজন পরিমাণ উচ্চতা বিশিষ্টি সুমেরু পর্বত অবস্থিত। সুমেরু পর্বতের দক্ষিণে হিামালয়, হেমকুট ও নিষাধ পর্বত এবং উত্তরে নীল, শ্বেত ও শৃঙ্খী পর্বত অবস্থিত। সুমের পর্বতের চারিদিকে মন্দার, গন্ধমাদন, সুপার্শ্ব ও বিপুল নামক চারটি পর্বত রয়েছে। ঐ সব পর্বতের উপর আম্র, জম্বু (জাম), কদম্ব ও বট এই চার প্রকার বিশাল বৃক্ষ আছে এবং ঐ বৃক্ষগুলোর নিকটে অরুণোদ, মহাভদ্র, অসিতোদ ও মানস নামক চারটি বিশাল সরোবর (হ্রদ) আছে। সুমেরুর পূর্বদিকে চৈত্ররথ বন, পশ্চিমে বৈভ্রাজক বন, উত্তরে নন্দনকানন এবং দক্ষিণে গন্ধমাদন বন অবস্থিত। জম্বুদ্বীপ সাতটি বর্ষে বা স্থানে বিভক্ত, যথা- ভারতবর্ষ, কিম্পুরুষবর্ষ, হরিবর্ষ, কুরুবর্ষ, ইলাবৃত্তবর্ষ, ভদ্রাশ্ববর্ষ ও কেতুমালবর্ষ। এই সপ্ত-স্থানের মধ্যে ভারতবর্ষ শ্রেষ্ঠ। বিষ্ণুপুরাণে উল্লেখ আছে, ‘‘জম্বুদ্বীপের মধ্যে ভারতবর্ষই সর্বশ্রেষ্ঠ কারণ এই ভারতবর্ষই প্রকৃত ধর্মভূমি ও কর্মভূমি। জগতের অন্য সমস্ত স্থান ভোগভূমি। সহস্র সহস্র জন্মের পর এবং বহুজন্মের পুন্যফলে জীবগণ কদাচিৎ এই ভারতবর্ষে মনুষ্য-জন্ম লাভ করে’’।
প্রলয়
সৃষ্টি ও প্রলয় মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। যার সৃষ্টি আছে তার প্রলয়ও আছে। তাই জগতেরও একদিন প্রলয় ঘটবে। প্রলয় চতুর্বিধ, যথা- নিত্য, নৈমিত্তিক, প্রাকৃত ও আত্যমিত্মক প্রলয়। এই জগতে প্রতিদিন সুষুপ্তি বা স্বপ্নহীন নিদ্রার সময় সমস্ত ভূতের যে লয় হয়ে থাকে, তাকে নিত্য প্রলয় বলে। কল্প অমেত্ম ব্রহ্মার নিদ্রাগমনের সময়কে ব্রহ্মার রাত্রি বলে। ঐ ব্রহ্মার রাত্রিতে মর্ত্য, অন্তরীক্ষ ও স্বর্গ এই ত্রিলোকের যে লয় হয়, তাকে নৈমিত্তিক প্রলয় বলে। মহৎ, পঞ্চ-তন্মাত্র, পঞ্চভূত, ইন্দ্রিয় প্রভৃতি প্রাকৃত-সৃষ্টির যে লয় হয়, তাকে প্রাকৃত প্রলয় বলে। তত্ত্বজ্ঞানী যোগীগণের আত্মা যখন পরমাত্মাতে লয় হয়, তখন তাকে আত্যন্তিক প্রলয় বলে।
