ইরাকের ইয়েজিদিরা কি প্রাচীন বৈদিক হিন্দু ? - হিন্দু পেইজ

হিন্দু পেইজ

সনাতনী সংবাদ বিশ্বময়

Breaking

Tuesday, February 11, 2020

ইরাকের ইয়েজিদিরা কি প্রাচীন বৈদিক হিন্দু ?

ভারতবর্ষ থেকে অনেক দূরে, মধ্যপ্রাচ্যের মরুভূমি অঞ্চলে, ভোর ও সন্ধ্যায় পাথর দিয়ে তৈরি করা দেবালয়গুলি থেকে ভেসে আসে শঙ্খধ্বনি বা উলুধ্বনির মত মাঙ্গলিক কিছু শব্দ। ঊষর মরুভূমির মতো রুক্ষ পরিবেশে, সকাল ও সন্ধের মিঠে হাওয়া ধরে অনেক দূরে পৌঁছে যায় শব্দগুলি। ছোট ছোট পাথুরে ঘর থেকে নতুন করে উলুধ্বনির মাঙ্গলিক শব্দ ভেসে ওঠে। মধ্যপ্রাচ্যের প্রধান ধর্ম ইসলাম! কিন্তু, এগুল তো ইসলাম ধর্মের ঈশ্বর আরাধনার রীতি নয়! তা হলে এঁরা কারা?

এঁরা হলেন ইয়েজিদি। অনেক ঐতিহাসিকের মতে, এঁরা সুপ্রাচীন সুমেরীয় সভ্যতার উত্তরপুরুষ। এঁদের ক্যালেন্ডার ৬,৭৫৬ বছর পুরনো। প্রায় ৫০০০ বছর ধরে, তাঁরা মধ্য প্রাচ্যে বাস করে আসছেন। প্রায় ৭৩ বার তাঁদের ইসলামিক গণহত্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। অটোমান মিলিশিয়া দিয়ে শুরু, ইসলামিক স্টেট দিয়ে এখনও চলছে, এই গণহত্যা কি কোনদিন শেষ হবে?
বোরখা পরে পরিচয় গোপন করার বিপদ থেকে সন্ত্রাসবাদ উৎপত্তির আশঙ্কার জন্য বোরখা পরা নিষিদ্ধ করলে, তখন বিশ্ব জুড়ে মানবাধিকার সংগঠগুলো ঝাঁপিয়ে পড়ে, কিন্তু ইয়েজিদিদের গণহত্যা সম্পর্কে কোন মানবাধিকার সংগঠনের কোন শব্দই নেই।

এর মাঝে ইয়েজিদিদের গণহত্যা চালিয়ে গিয়েছে কুর্দ ও তুর্কি মুসলিমরা। ইয়েজিদিদের একটাই অপরাধ। তাঁরা ইসলাম ধর্মাবলম্বী মুসলমান নয়, তাঁরা বিধর্মী কাফের। তাঁদের নিজস্ব ধর্ম আছে। তাঁরা পৌত্তলিক। তাঁরা "মালেক টাউস" নামে এক দৈব ময়ূরকে নিজেদের ঈশ্বর বলে মানেন।  সূর্য, প্রকৃতি, বাতাস ও জলকেও ঈশ্বর রূপে মানেন।

এমনকি মধ্যপ্রাচ্যের ইয়েজিদিদের মেরে শেষ করে দিতে চাইছে আইসিস।

আবু-বকর-আল-বাগদাদির ইসলামিক স্টেট এর উগ্রপন্থীরা, ২০১৪ সালে ইরাক আক্রমণ করে। আক্রমণ করে ইয়েজিদিদেরও। কুর্দিস্তান রিজিওনাল গভর্মেন্ট আগেই ইয়েজিদিদের অস্ত্র কেড়ে নিয়েছিল। ফলে নিরস্ত্র অসহায় ইয়েজিদিরা অকাতরে মারা পড়তে থাকেন। অনেকে পালিয়ে যান ওই অঞ্চলের দুর্গম, রুক্ষ পাহাড় মাউন্ট সিনজারে। আগস্টের গরমে, অনাহারে,পানীয় জলের অভাবে মাত্র দশ দিনে মারা যান প্রচুর বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। মারা যায় কয়েকশো ইয়েজিদি শিশুও।

আইসিসদের হাত থেকে ইয়েজিদিদের বাঁচাতে এগিয়ে আসে, সিরিয়ার স্বশস্ত্র  গেরিলা বাহিনী ওয়াই.পি.জি। কোনক্রমে পৃথিবী থেকে একেবারে অবলুপ্ত হতে হতে বেঁচে যায় ইরাকি ইয়েজিদিরা।

ইয়েজিদি জনগোষ্ঠীর মূল নিবাস ইরাকের নিনেভ রাজ্যে। ক্রমাগত নির্মম গণহত্যার পরিণামে জনসংখ্যা কমতে কমতে এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র তিন লক্ষে। হাজার হাজার বছর ধরে চলা অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে নিজেদের জন্মভূমি ছেড়ে আরও কয়েক লক্ষ ইয়েজিদি ছড়িয়ে পড়েছেন সিরিয়া, আর্মেনিয়া, জর্জিয়া, আলবেনিয়া, রাশিয়া এমনকি আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন সুদূর সুইডেনেও।

ইসলামিক স্টেটের আক্রমণে দিশেহারা নিরস্ত্র অসহায় ইয়েজিদি জনগণ।
কারণ ইয়েজিদি জনগোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের চারপাশে থাকা অন্যান্য জনগোষ্ঠীর কোনও ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক মিলই নেই। ইয়াজিদিদের জীবন যাত্রা,সংস্কৃতি ও ধর্মীয় রীতিনীতির সঙ্গে বরং হিন্দুদের জীবন যাত্রা, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় রীতিনীতির অবিশ্বাস্য রকমের মিল রয়েছে, দূরত্ব হাজার হাজার কিলোমিটার হওয়া সত্বেও। চারদিকে সৌদি আরব, জর্ডন, তুরস্ক, ইরান, সিরিয়ার মতো চরম কট্টরপন্থী ইসলামি দেশ থাকা সত্বেও কী ভাবে এত মিল হয়, সেটাই চরম আশ্চর্যজনক ব্যাপার।

দেখা যাক, কেন মনে হয়, ইয়েজিদিরা প্রাচীন হিন্দু ধর্মেরই কোনও এক শাখা!!

● ইয়েজিদিদের মন্দিরগুলি দেখতে একদম ভারতীয় মন্দিরগুলির মতো। মধ্যপ্রাচ্যের অনান্য ধর্মস্থানের সঙ্গে মন্দিরগুলির স্থাপত্যের দিক থেকে কোনও মিল নেই। বরং ভারতবর্ষের গোপূরমের মন্দিরগুলির সঙ্গে ইয়েজিদিদের মন্দিরের স্থাপত্যের হুবহু মিল দেখতে পাওয়া যায়।

ইয়েজিদিদের পবিত্রতম "লালিশ মন্দির" এবং ইয়েজিদি মন্দিরে সর্প-প্রতীক।

● ইয়েজিদিদের পবিত্রতম মন্দির, লালিশ মন্দিরের প্রবেশ পথে সর্প-প্রতীক দেখতে পাওয়া যায়। ইয়েজিদিদের কাছে সাপ পবিত্র এক প্রাণী।  দক্ষিণ ও পূর্ব ভারতের, এমনকি মেক্সিকোর বহু মন্দিরেও, প্রবেশ পথের ওপরে ও পাশে সর্প-প্রতীক দেখা যায়।

● দক্ষিণ ভারতের দেবতা মূরূগন (বঙ্গ দেশের কার্তিক সদৃশ) নাগদের অবতার স্বরূপ। এছাড়াও বাংলার মনসাপুজা, সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে নাগপঞ্চমী, হিন্দুধর্মের পূজাঅর্চনার সঙ্গে সর্পশ্রেণির যোগসূত্র প্রমাণ করে।

ইয়েজিদিদের প্রধান দেবতা মেলেক টাউস।

● ইয়েজিদিদের প্রধান আরাধ্য হলেন, দুই পাখনা মেলা ময়ূর-দেবতা মেলেক টাউস (Melek Taus)। উত্তর ভারতের কার্তিক, যিনি দক্ষিণ ভারতের দেবতা মুরুগন। একই রকম ময়ূরের পিঠে বসা দেবতা। হিন্দুদের শ্রীকৃষ্ণ এবং কার্তিক ঠাকুরের সঙ্গে ময়ূরের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক আমরা সবাই জানি। অথচ শুনলে অত্যন্ত অবাক হবেন যে ইয়েজিদিদের বাসস্থান ইরাকের নিনেভ রাজ্যের হাজার মাইলের মধ্যে কোন ময়ূর পাওয়াই যায় না। অথচ, ময়ূর বাহক দেবতা ইয়েজিদিদের প্রধান দেবতা। অন্যদিকে ভারতের জাতীয় পাখি ময়ূর।

● শুধু তাই নয়, ইয়েজিদিরা ময়ূর আকৃতির প্রদীপ জ্বালিয়ে, প্রথমে ময়ূর মূর্তিতে চুম্বন করে পূজার্চনার শুভারম্ভ করেন। ভারতবর্ষের কেদারনাথ, বদ্রীনাথ, হরিদ্বার, কাশি বিশ্বনাথের মন্দির থেকে শুরু করে প্রায় সমস্ত হিন্দু মন্দিরে, ময়ূর আকৃতির প্রদীপ জ্বালাতে দেখা যায়।

ইয়েজিদি মন্দিরের দেওয়ালে আঁকা, শাড়ি ব্লাউজ পরা রমনীর ছবি। খোঁপায় ফুলের মালা

● ইয়েজিদিদের পবিত্রতম "লালিশ মন্দিরের" দেয়ালে আঁকা এক নারীর ছবি, ইয়েজিদিদের সনাতন ধার্মিক হিন্দু হওয়ার সপক্ষে যা একটি অকাট্য প্রমাণ। ছবিটি ময়ূরদেবতার সামনে বসে থাকা এক রমণীর প্রতিমূর্তি। যে রমণীর প্রতিমূর্তির পরনে আঁচল দেওয়া শাড়ি, এমনকি তাঁর শাড়িতে পাড়ও দেখতে পাওয়া যায়। ভারতীয় হিন্দু মহিলাদের মতন তাঁর পরনে আছে ব্লাউজ। এমনকি তাঁর খোঁপায় ফুলের মালা।

● ছবিটি দেখলেই একদম স্পষ্ট মনে হবে কোনও ভারতীয় মহিলার ছবি।  এই পোশাক, ইয়েজিদি জনগোষ্ঠীর হাজার মাইল চৌহদ্দির মধ্যে থাকা, অন্য কোনও জনগোষ্ঠীর মধ্যে দেখা যায় না, যাওয়ার কোন সম্ভাবনাই নেই। অন্যদিকে শাড়ি হল, ভারতে মহিলাদের জাতীয় পোশাক।

● ইয়েজিদিদের আরেকটি প্রতীক হলো গৈরিক আভা সম্পন্ন হলুদ সূর্য,যার একুশটি রশ্মি, ভারতীয় সনাতন ধর্মে একুশ সংখ্যাটি অত্যন্ত পবিত্র, ইয়েজিদিরা একুশবার দেবতাকে নৈবেদ্য উৎসর্গ করেন। হিন্দুরাও গণেশপূজায় একুশবার লাড্ডু উৎসর্গ করেন। খুব অবাক হচ্ছেন নিশ্চই।

● হিন্দুরা ঠিক যে রকম ভাবে, পূজার থালায় প্রদীপ বসিয়ে থালা সমেত হাত ঘুরিয়ে দেবতার মূর্তিকে প্রদক্ষিণ করে আরতি করেন। ইয়েজিদিরাও ঠিক সেই ভাবেই আরতি করেন। শুধু তাই নয় ইয়েজিদি মন্দিরে আরতি করেন ইয়েজিদি রমনীরা, অর্থাৎ ইয়েজিদি সমাজেও ঠিক প্রাচীন হিন্দু সমাজের মতনই নারীর পুরুষের সমান ধর্মাচরণ এবং পুজোপাঠের অধিকার স্বীকৃত এবং রক্ষিত।

● হিন্দুরা দেবালয়ে হাতজোড় করে দেবতার মূর্তির সামনে প্রার্থনা করেন। ইয়েজিদিরাও ঠিক ওই ভাবেই তাঁদের মন্দিরে  প্রার্থনা করে থাকেন।

● হিন্দুদের মতই ইয়েজিদিরা সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তর সময়ে পূজাপ্রার্থনা করেন।

● হিন্দুদের মতোই ইয়েজিদিরা পুজোর পর কপালে টিকা বা তিলক লাগান। এবং পুজার শেষে ইয়েজিদি পুরোহিত পবিত্র তিলক পরিয়ে দেন ভক্তদের কপালে।

● হিন্দুদের মতোই ইয়েজিদিরা পুজো গৃহে আল্পনা করেন।

● বড় বড় উৎসবে, "লালিশ মন্দিরের" আঙিনায় অসংখ্য প্রদীপ জ্বালান ইয়েজিদিরা। ঠিক হিন্দুদের দীপাবলীর মতই।

● ইয়েজিদি পুরোহিত হিন্দুদের মতোই আগুন জ্বালিয়ে যজ্ঞ করেন। হিন্দুদের মতই যজ্ঞের আগুন অত্যন্ত পবিত্র বলে মনে করেন ইয়েজিদিরা। সেই আগুনের ছাইতে তাঁরা কখনও পা লাগতে দেন না।

● এখনও আরও অবাক হওয়ার বাকি আছে। ইয়েজিদি মন্দিরের মধ্যে ত্রিশূল আকৃতির ধাতব শলাকা, ঘট আকৃতির জলের পাত্র দেখতে পাওয়া যায়।

● পূজার সময় শঙ্খধ্বনির মতো আওয়াজ করা হয় এক বিশেষ বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে, ঢোল জাতীয় বাদ্যযন্ত্র বাজানো হয়, উলুধ্বনি দেওয়া হয়।

● হিন্দুরাও পুনর্জন্মে বিশ্বাস করেন।  ইয়েজিদিরাও পুনর্জন্মে বিশ্বাস করেন।

● হিন্দুরা সুন্নত করেন না। মধ্যপ্রাচ্যে বসবাস করেও ইয়েজিদিরাও মধ্যপ্রাচ্যের সংখ্যা গরিষ্ঠ ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের মত সুন্নত করেন না।



ইয়েজিদিদের হোম

এ ছাড়াও  বৈদিক হিন্দুধর্মের আরও কিছু রীতিনীতির সঙ্গে, ইয়েজিদিদের ধর্মীয়, সাংসারিক ও সাংস্কৃতিক রীতিনীতির অস্বাভাবিক মিল দেখতে পাওয়া যায়। এর ফলেই হয়ত আমেরিকায় গড়ে উঠেছে ‘ইয়েজিদি সনাতন ধর্ম সোসাইটি’। এই সোসাইটি আমেরিকা প্রবাসী হিন্দু ও ইয়েজিদিরা তৈরী করেছেন। দুটি গোষ্ঠীর মধ্যে বহু হাজার বছরের ফিকে হয়ে যাওয়া আধ্যাত্মিক এবং আত্মিক বন্ধনকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত এবং শক্তিশালী করতে।

এঁদের মতে ইয়েজিদিদের প্রাগৈতিহাসিক প্রাচীন পূর্বপুরুষরা ৬৫০০ বছর পূর্বে ভারতবর্ষেই ছিলেন, আজ থেকে  প্রায় ৫০০০ বছর আগে, ইয়েজিদিরা ভারতবর্ষ থেকে আফগানিস্তান, ইরান হয়ে ইরাকে পৌঁছেছিলেন। ইয়েজিদিদের দেবতা ‘মেলেক টাউস’,আসলে দক্ষিণ ভারতীয় দেবতা মুরগনেরই (কার্তিক) প্রতিমূর্তি। এমন কি ইয়েজিদিদের পবিত্র গ্রন্থগুলিও সংস্কৃত বংশদ্ভূত আভেস্তা ভাষায় লেখা।

ভাষার স্বাভাবিক পরিবর্তিত উচ্চারণের প্রতিষ্ঠিত রীতি অনুসারে, প্রাগৈতিহাসিক সংস্কৃত ভাষার প্রাচীন শ্লোকসমূহ, শ্রবনে এবং উচ্চারণে সছন্দেই আভেস্তা ভাষায় রূপান্তরিত হতে পারে।

উদাহরণ: সংখ্যা
বাংলা --- সংস্কৃত --- আভেস্তান
১ --------- একহঃ --------- এঈঊআ
২ --------- দ্বহঃ --------- দুয়া
৩ --------- ত্রি --------- ওরেই
৪ --------- চতুর --------- চতুর
৫ --------- পঞ্চ --------- পঞ্চ
৬ --------- ষষ্ঠহঃ --------- ক্সসুয়াস (জসুয়াস)
৭ --------- সপ্ত --------- হপ্তা
৮ --------- অষ্ট --------- অষ্ট
৯ --------- নভহঃ --------- নাউউয়া
১০ --------- দশঃ --------- দশঃ

উদাহরণ: শব্দ
বাংলা --- সংস্কৃত --- আভেস্তান
সোনা ------ হিরণ্য ------ ক্সারণ্য (জারণ্য)
সৈন্য ------ সেনা ------ হেনা
বর্ষা ------ ঋষ্টি ------ আর্সটি
সতন্ত্র ------ ক্ষত্র ------ ক্সস্যুরা (জস্যুরা)
রক্ষঈশ ------ অসূরা ------ আহুরা
আহুতি ------ যজ্ঞ ------ যশ্ন
যজ্ঞ পুরোহিত ------ হোতারঃ ------ জাওতার
যোগ্যাম্রিত ------ সোমা ------ হওমা
আর্য ------ আর্য্যমান ------ আইরয়ামান
দেবতা ------ দেবাঃ ------ ডেইভা

Pages